Monday, October 19, 2009

একজন অন্ধ মানুষ

অনেকদিন ধরে একটা বিষয় নিয়ে লিখতে চাচ্ছি, কিন্তু লেখতে পারতেছি না, এমন এক বিষয়ে আমার এই লেখাটা যা আমার মনে অনেকদিন ধরেই যন্ত্রনা দিয়ে যাচ্ছে, লিখে হয়ত এই যন্ত্রনা আরো ছড়াব বই আর কিছুই করতে পারবো না। যে কারনে অন্য বিষয় নিয়েও মন খুলে লিখতে পারছি না, কিছু লিখতে গেলেই এই যন্ত্রনা বের হবার পথ খুঁজে। এই লেখাটা কাউকে হেয় করার জন্যে নয়, নিতান্তই একজন মানুষের ঘটনা, সে যদি কোন দিন এই লেখাটা পড়ে, হয়ত আর জীবনে আমার সাথে কথাই বলবে না, কিন্তু, প্রায় ২০ বছর ধরে আমি এই বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি, আর আজকে লিখতে বসেছি সেই ওজন কিছুটা হলেও হালকা করার জন্যে। এই চেষ্টা নিতান্তই স্বার্থপর, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ঘটনা আমার এক পারিবারিক ভাবে পরিচিত ব্যক্তিকে নিয়ে। স্বভাবতই নাম গুলো কাল্পনিক, যাতে করে কেউ হুট করে চিনে বের করতে না পারেন। আর কথা না বাড়িয়ে আসেন তার কথা শুনি। আমি যতটুকু জানি, ততটুকুই বলার চেষ্টা করব।তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি চোখে দেখেও অন্ধ, নিজে না দেখলে হয়ত বিশ্বাস করতাম না, মানুষ এমন সব বিভ্রান্ত ধারনা নিয়ে চলে।

সালাম এর সংসারে মা আর বোন ছাড়া কেউ নেই। তখন ব্রিটিশ শাসন, তার বয়স যখন ৩ বছর, তখন তার বাবা মারা যান যক্ষা রোগে, সে তখনো কিছুই বুঝতো না, তার মাকে যৌবনে বিধবা হয়ে তার ভাসুর আর শ্বশুরের জ্বালায় গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়, সে গল্প না হয় আরেকদিন বলা যাবে। যাক, সালাম আস্তে আস্তে বড় হয়, তার মা তখন তখন ভাইয়ের বাসায় থাকেন ২ ছেলেমেয়ে কে নিয়ে। স্বামীর তাকে দিয়ে যাওয়া কিছু জমি ছাড়া আর কিছুই নেই, কিন্তু তাতে দমবার পাত্রী নন তিনি। তার আরেক ভাই ঢাকা শহরে থাকেন জেনেও সেখানে জান নি, যদি তার ছোট ২ ছেলেমেয়ে গাড়ি চাপা পরে মারা যায়। এভাবে দিন চলতে থাকে, সালামের বয়স ৫ হয়। সে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। ভাই বোন দুজনেই খুব মেধাবি, কাজেই তার মাকে কোন পয়সা দিতে হয় না স্কুলে। বছর ঘুরতেই তার মেধার কথা সবাই জেনে যায়। স্কুলের শিক্ষকরা তাকে একটু যত্ন নিয়ে পড়াতে থাকে। এভাবে সে আস্তে আস্তে ৭ পেরোয়, তখন তার মা তাকে বলে, যা বাবা, ৫ওয়াক্ত নামায পড়তে হবে এখন থেকে, আর জুম্মার নামাযটা মসজিদে গিয়ে পড়বি। কিন্তু সালাম খুব ভয় পায়, আর তার নাকি লজ্জাও লাগে। সে কোন ভাবেই রাজি হয় না, গো ধরে থাকে, কিন্তু তার মা তাকে নানা ভাবে ফুসলিয়ে ফাস্লিয়ে তাকে মসজিদে যাবার তাগাদা দিতে থাকে। শেষমেষ তাঁর মা তাকে রাজী করায় যে, এক্কেবারে শেষে যাবে মসজিদে, সবার শেষে গিয়ে দাঁড়াবে, ফরয তো মাত্র ২ রাকাত, নামায শেষ হলেই দৌড় দিয়ে চলে আসবে। সালাম রাজী হয়ে যায়, হাজার হলেও মা ছাড়া তার আর কেউ নেই।

এভাবে বড় হতে থাকে সালাম, একদিন বাজার করতে যায় সে, মা বলে দিয়েছে, মুরগি কিনে আনতে, সে ভুলে যাবে বলে প্রথমে গিয়ে মুরগি কিনে, তারপর অন্যান্য বাজার করে বাসায়া সে, তারপর মা ব্যাগ হাতে নিয়ে বলে, কিরে মুরগি কই? সে বলে, কেন ব্যাগের নিচে, শুনে তো মা এক চিৎকার দিয়ে উঠেন, বলেন, করেছিস কি তুই। মুরগি বের করে দেখেন দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে মুরগি। মার তো একটাও মাটিতে পড়েনা। এর মাঝে কয়েকবার তিনি চেষ্টা করেছেন নিজের স্বামীর ভিটাতে ফেরত যেতে, এর মাঝে খবর আসে, তার শ্বশুর মারা গেছেন, কাজেই তার ভাসুরেরা এখন আর অতটা ঝামেলা করবেন না, তিনি চাইলে ফেরত আসতে পারেন। কাজেই আশায় বুক বেঁধে তিনি ছেলেমেয়ে কে নিয়ে ফেরত আসেন স্বামীর ভিটায়, এখানে এসে ছেলে মেয়েকে আবার স্কুলে পাঠান তিনি, তার স্বামীর দিকের আত্মীয়স্বজনেরা নানা ভাবে জ্বালা যন্ত্রনা করতে থাকেন, তারপরেও তিনি মুখ বুজে দিন চালিয়ে যেতে থাকেন। এর মাঝে তার ছেলেমেয়ের মেধার খবর আবারো ছড়িয়ে পড়ে। ২ জনেই যার যার শ্রেনীতে প্রথম হয়, না জানার কোন কারন নেই। তখন বসন্ত কাল ছিল, তার বাড়ির পিছনে বিশাল কাঁঠাল গাছে বিরাট এক মৌমাছির চাঁক বাসা বেঁধেছে, তিনি এক প্রতিবেশিকে দিয়ে সেই চাঁক ভাঙ্গান, কিন্তু সেই লোকটা খুব অপটু ভাবে কাজটা করে, গাছের নিচে কিছুটা মধু পড়ে থাকে। ধোঁইয়া দিয়ে তাড়ানো সব মৌমাছি সেই মধুর গন্ধে ফিরে আসে, তারপর ক্রোধে অন্ধ হয়ে ঘুরতে থাকে প্রতিশোধের লোভে। পরদিন সকালে সালাম আর তার বোন হাত মুখ ধুতে বের হয়ে আসে, এসে পড়ে মৌমাছির খপ্পরে, ২ জন তাড়া খেয়ে ২ দিকে দৌড়ায়, কিন্তু তার বোন কিভাবে যেন কাছে পুকুর পেয়ে যায়, সে গিয়ে এক লাফে পুকুরে নেমে যায়। কিছু বেচারা সালামের ভাগ্যটা এত ভালো ছিল না, তাকে তারা করতে করতে মৌমাছি ধরে ফেলে, তারপর ফুটাতে থাকে অসংখ্য হুল। সারা গা ফুলে যায় সালামের, ৩জন লোক মিলে তার গা থেকে হুল তুলতে হয় সে যাত্রায়। একমাস বিছানায় কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠে সালাম।

এভাবে মেট্রিক পরীক্ষায় সময় আসে, সালাম এত নরম সরম মানুষ যে, কেউ তার জীববিদ্যার ব্যবহারিক খাতা চাইলে সে না করতে পারে না, তার সহপাঠীরা তার খাতা নিয়ে দেখে দেখে ছবি আকে, এমন করতে করতে কেউ একজন খাতা মেরে দেয়। কিন্তু পরীক্ষায় তাতে সালামের কোন সমস্যা হয় না। সে যেন বিকারহীন, খাতা হারানোর জন্যে তার মায়ের কাছে থেকে মাঝারী মাপের মার খাওয়া লাগে, কিন্তু তার শিক্ষক বলেছেম আরে সালাম তোর খাতা তো আমাদের সবার মুখস্ত, তোর খাতা লাগবে না। আর এদিকে যে চুরি করেছে, সেও ব্যবহার করতে পারে না, কারন সবাই চিনে সেই খাতা। মেট্রিকে খুব ভালো ফল করায় ভালো কলেজে বিনা খরচে পড়ার সৌভাগ্য হয়। সে গনিতে আর বিজ্ঞানে খুবই ভালো, কাজেই কলেজেও অনেক সুনাম তার। জীবনে সে অংকে ৯৮ এর নিচে পায়নি। তখন পাকিস্তান আমল, বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে কেউ পড়তে চায় না, কিন্তু তার খুব শখ সে প্রকৌশলী হবে, তাই সে ভর্তি হয় ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি তে (আগে এর নাম ছিল আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ১৯৬২ তে হয় ইপুয়েট, তারপর ১৯৭১ এ আবার নাম পালটে হয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি)।

ঢাকায় এসে থাকে সালাম, তখন তার মা আর বোন থাকে ময়মনসিংহ শহরে, কারন সে পড়ে ময়মনসিংহ মেডিকেলে। নানা বাধা বিগ্রহ পার করে অনেক কষ্টে তার মা তাদের এপর্যন্ত নিয়ে আসতে সক্ষম হন। হলে থাকতে হয়, কাজেই এটা তার জন্যে পুরাই নতুন ভুবন। এর মাঝে সে কিনা খপ্পরে পড়ে তাব্লিগ জামাতি দলের হাতে। যে কিনা মসজিদে যেতে ভয় লজ্জা পেত, সে সার্ট প্যান্ট ছেড়ে পায়জামা পাঞ্জামি পড়তে শুরু করে। মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে যেতে থাকে সালাম। এর মাঝে দেশে যুদ্ধ লেগে যায়, সে গ্রামে চলে আসে, চারিদিকে গন্ডগোল, জানের ভয়ে লুকিয়ে থাকে গ্রামে। এর মাঝে তার দাঁড়িও গজায় একটা। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে সে আবার ঢাকায় ফিরে আসে, তার ১ বছর পর সে পাশ করে বের হয়। চোখে নানা স্বপ্ন, দেশ গড়তে হবে, দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। পাশ করায় আগেই চাকরির ডাক পেয়ে যায়। সে যোগ দেয় বিএডিসিতে। এখানে এসে এক্কেবারে খাস তাব্লিগি বসের পাল্লায় পড়ে সালাম। চোখ বন্ধ করে কাজ করে যেতে থাকে সালাম। সে বুঝতেও পারে না, আস্তে আস্তে তার মগজ ধোলাই হয়ে যাচ্ছে এই সব মোল্লাদের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে। তার এই তাব্লিগি দলের প্ররোচনায় বিয়েও করে ফেলে সালাম। মেয়ের বাবা তাব্লিগি দলের খুব শ্রদ্ধেয় নেতা, মোটামুটি দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে কাকরাইল মসজিদে। বিয়ের পর শ্বশুরের কথায় উঠতে বসতে থাকে সালাম। তারপর শুরু হয় চিল্লায় যাওয়া। সালাম বলে, কাজ ফেলে আমি যাব কিভাবে? শ্বশুর হেসে বলেন, আরে, তোমার বস তো আমার বন্ধু মানুষ, তাকে বলে দিব, কোন ব্যাপারই না।

সেই যে শুরু হল, ধর্মের নেশায় অন্ধ হয়ে যায় সালাম। অফিসের কাজ উচ্ছন্নে যেতে থাকে, কেউ যদি কাজ ফেলে ৪০ দিন মসজিদে বসে থাকে, তাহলে কাজ হবে কিভাবে? আর কোন জবাবদিহিতাও নাই, কারন তার বস, তার সহকর্মীরাও সবাই তো তার সহযাত্রী, তারাও কোথাও না কোথাও চিল্লায় ব্যস্ত। কিসের দেশ গঠন আর কিসের দেশ সেবা। আস্তে আস্তে স্ত্রীকে নিয়েও যাওয়া শুরু করে সালাম চিল্লায়। তার মা বোন নানা ভাবে তাকে বুঝাতে চায়, ধর্ম পালন করতে গিয়ে ফ্যানাটিক হয়ে যাবার তো কিছু নাই। কিন্তু এসব কথা শুনতে সালামের তো আর ভালো লাগে না, তাই সে আস্তে আস্তে মা বোনের থেকেও দূরে সরে আসে। সংসার, চাকরি ফেলে কিভাবে সে এসব করে তা নিয়ে তার মা বোন প্রশ্ন করলে সে বলে, আল্লাহ থাকতে চিন্তা কি? উনি সব চালায় নেন। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে যায় তার একান্ত কাছের এই ২ মানুষ। তারাও আস্তে আস্তে বলা বন্ধ করে দেয়। তারা ভাবেন, বোধহয় বাচ্চা কাচ্চা হলে এসব বন্ধ হবে, কিন্তু কিসের কি, সালামের ঘর উজ্জ্বল করে আসে একটি পুত্র সন্তান। নাতিকে নিয়ে দাদীর কত স্বপ্ন, কিন্তু, সেই নাতীকে দেখাতেও নিয়ে আসে না সালাম। কারন তার নিজেরই সময় নেই, সে চিল্লা দিতে গেছে, বাচ্চা হবার ১০ দিন পর ফিরে আসে সালাম। একপর্যায়ে তার মা আর থাকতে না পেরে নিজে এসে হাজির হয় নিজের ছেলের ঘরে নাতি দেখতে। যদিও তার মেয়ের ঘরে একটা নাতি হয়েছে। কিন্তু তারপরেও দাদী হবার অনুভূতি যেন আলাদা।

বাচ্চা হওয়ায় স্ত্রীকে নিয়ে দৌড়ানো স্থগিত করতে বাধ্য হয় সালাম, কিন্তু বছরে ৩-৪ বার করে সে চিল্লায় যেতে থাকে, আর কাকরাইল মসজিদ ও আছেই, নেশাগ্রস্তের মত সেখানে গিয়ে হাজির হয় সে, এর মাঝে তার পদোন্নতি হয় সেখানে। তাকে এখন নানা কাজের দায়িত্ব দেওয়া হুয়েছে। বিদেশ থেকে যারা আসেন তাবলিগ করতে, তাদের দেখভাল করে সালাম। আর সৎ হিসাবেও তার অনেক সুনাম। এদিকে অফিসের কাজ তো লাটে উঠে বসে আছে। এভাবে ৪-৫ মাস চিল্লায় থাকলে অফিসের কাজ হবে কিভাবে? কিন্তু, ঐযে, কোণ জবাবদিহিতা নেই, ফলে ফাইল আটকে থাকে, এদিকে ঘুষ খায় না বলে অফিসেও তার সুনামের পাশাপাশি দুর্নাম ও হতে থাকে। ঘুষ খাবারোতো একটা লাইন ঘাট আছে, মাঝে একজন ঘুষ না খেলে মহা বিপদ, তার টেবিলে ফাইল আসলেই তার অনুপস্থিতিতে এমনিতেই বসে থাকে, তারপর সে ফিরে এসে দেখে নানা রকমের গোজামিল দিয়ে ভরা ফাইলগুলো। এসবের মাঝে আবার তার আরেকটা কন্যা সন্তানো জন্ম হয়, তার বোন তাকে বলে, ২ টা হয়ে গেছে, এবার বাচ্চাকাচ্চা নেয়া বন্ধ করা উচিত। এসব শুনে যেন সালামের মাথা গরম হয়ে উঠে। আল্লাহর দেখানো রাস্তায় বাধা দেবার সে কে? তার ভাগ্যে যদি আরো সন্তান আসার থাকে আসবে। এভাবে আরো একটা মেয়ের জন্ম হয়। এর মাঝে তার অফিসেও পদোন্নতি হয়, যেটা ৫ বছরে হবার কথা সেটা হতে ১০ বছর লাগে, লাগবেই তো, কারন অই ১০ বছরের ৫ বছর তো সে কাটিয়েছে অফিসের বাইরে। তাবলিগের নামে সে নানা দেশেও যায়, তার তাবলিগ জামাতের লোকজনের সাথে।

এদিকে তার মার মায়ের কত স্বপ্ন, তার ছেলের ঘরের নাতিপুতি বাপের মত পড়াশুনা করে বড় বড় পদে আসীন হবে, কিন্তু তার মায়ের আশায় ছাই ঢেলে দেয় সালাম। সে তার বড় ছেলে এবং মেয়েকে ভর্তি করে দেয় মাদ্রাসায়। মাদ্রাসায় কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সালাম তখন এতটাই ধর্মান্ধ হয়ে গেছে যে তার ছেলে কে হাফেজ বানাতে উম্মত্ত হয়ে যায়। ছেলে থাকে চাঁদপুরের এক মাদ্রাসায়, আর মেয়ে কে মা গৃহ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে থাকে। সালামের বউ হাতে গোনা কয়েকটা জিনিষ ভালো পারে, অন্যের দুর্নাম করা আর দোষ ধরা, আর রান্না করতে। অসাধারন তার রান্নার হাত। যাবতীয় খান্দানি রান্নায় তার অপুর্ব গুনাবলীর প্রকাশ পায়।

আমেরিকা আসে সালাম তাবলিগের কাজে, ঘরে তার স্ত্রী আবারো সন্তান সম্ভবা, আসছে তার চতুর্থ সন্তান, ছেলে হওয়ার এসে হাজির হয় সালাম। তার বোন এবারো তাকে খুব বকাঝকা করে, কারন বাচ্চার অবস্থানটা ছিল খুব সঙ্কটময়, কিন্তু,এ সব চিন্তা করার সময় তো সালামের নাই। অপারেশন করে জন্ম হয় তার চতুর্থ সন্তান, একটি ফুটফুটে ছেলে। এর সব ভ্যাজালের মাঝে সালামকে বদলি করা হয় চট্টগ্রামে। কালুরঘাটে অফিসে যায় সালাম। যাওয়ার পরের মাসেই আবার তাবলিগের কাজে বিদেশের পথে পাড়ি জমায় সালাম। ঘরে তার চারটে বাচ্চা, তার কোন বিকার নেই, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, আল্লাহ আছে, তিনি দেখার মালিক, তিনিই দেখে রাখবেন। কালুর ঘাটে গিয়ে সালামের সাদা রঙের চাকুরি জীবনে লেগে যায় কালো কালির ছিটা। এখানে নানা পদের মেশিনারি আমদানি হয়, তার দেখভাল করতে হয় সালামকে। সেরকমই এক চালানের মাঝে গড়বড় বের হয়, ৩ মাসের জন্যে বেতন আটকে যায় তার। এমনিতে সৎ মানুষ, আলগা কামাই নেই, বেতন আটকে যাওয়ায় ভীষন বিপদে পড়ে যায় সালাম। কাজেই বাধ্য হয়ে তার বোনের সাথে দেখা করতে হয়, কিছু টাকা পয়সা ধার করে সংসার চালাতে থাকে সালাম। তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়, কিন্তু সততার গুনে সে বেকসুর প্রমাণিত হয়।

কিন্তু তাকে আবারো বদলি করা হয়, এবারের গন্তব্য চাঁদপুর, এখানে আগে যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন, তার ঘুষের ক্ষিদা এতই বেশি যে, পারলে সে কুমিরের মত নিজের বাচ্চাই খেয়ে ফেলে। ফলে অফিসের সুনাম ফিরিয়ে আনতে বড়কর্তাদের সালামের মত সহজ সরল ধর্মান্ধ মানুষ দরকার, কাজেই সালাম গিয়ে যোগ দেয় সেখানে। কিন্তু আগের ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পতন এতটাই গভীর ছিল যে, সে এখান থেকে চলে যেতে চাইলেন না, তার কতজনের সাথে ব্যবসায়িক আতাঁত আছে, সেগুলো ছেড়ে নতুন স্থানে গিয়ে আবার নতুন করে পথ ঘাট চেনার সময় তার নেই, কাজেই সে লোক মারফত খবর পাঠায় সালামের কাছে যে, তাড়াতাড়ি এখানে থেকে সেচ্ছায় বদলি হয়ে চলে যেতে নাহলে তার জীবনের আশঙ্কা আছে। এসবে ভয় পাবার লোক সালাম নয়, সে একজন কেই ভয় পায়, তার আল্লাহ, তার সৃষ্টিকর্তা।

কিন্তু এখানে হিসাবে ভুল করে ফেলে সালাম। এক রাতে তার ঘরে ঢুকে পড়ে আততায়ী, এসে তাকে ছুরিকাহাত করে, ভাগ্যগুনে ছুরিটা ঢুকার সময় তার ডানহাতে আঘাত করে, তার ডানহাতের রগ (নার্ভ) ক্ষত হয় এবং একটা শিরা কেটে যায়, আর বুকের আঘাত পিছলে যায়, ২-৩ বার আঘাত করার পর আততায়ী পালিয়ে যায়। এতে করে সে খুব ভয় পেয়ে যায়। তারপর রক্তক্ষরনের জন্যে জ্ঞান হারায়, তারপর তার জ্ঞান ফিরে একটা ক্লিনিকে, তারপর সেখানে একটু সুস্থির হলে তাকে তার বোন নিয়ে যায় রাজশাহী। কারন তিনি তখন আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন। আর চাঁদপুরে তার নার্ভ বা শিরা কোনো টারই চিকিৎসা হবে না। ২ দিনের মাথায় সালাম এসে হাজির হয় আমাদের পাশের বাসায়। তারপরে ২ ধাপে তার অপারেশন করা হয়, নার্ভ কেটে গেলে আর তা পুরোপুরি ঠিক হয় না, ভাগ্যক্রমে তার নার্ভের ক্ষত একটু কম হওয়ায় তার হাতের শক্তি একটু কমে যায়, কিন্তু শিরাটা ঠিকঠাক মতই জোড়া দেওয়া যায়।

সালামের বড় ছেলে আমার এক বছরের বড়, আমার সাথে বেশ বন্ধুত্বই হল, তার ২ মেয়ে তো ঘোমটার আড়ালে, ফলে আমি তাদের দেখিনি কখনো। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ি, আর সালামের ছেলে পুরো দস্তর হাফেজ। কথা প্রসঙ্গে আমি একদিন সালামকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার যে এতগুলা ছেলেপেলে, বড় হয়ে তার কি করবে? সে খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল, কেন, আল্লাহ যা বানাবে, তাই হবে। আমি বললাম, কিছু হবার জন্যে তো সেই পথে ঘাটে কাজ করতে হবে, পড়াশুনা করতে হবে, যেমন আমি ডাক্তার হতে চাই, এজন্যে আমি স্কুলে পড়ছি, এরপর মেট্রিক ইন্টার দিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হব। আপনার বড় ২ ছেলে মেয়েকে যেভাবে পড়াচ্ছেন, তাতে তারা বড় হয়ে কি করবে? আমার ইচড়ে পাঁকা প্রশ্ন শুনে সালাম ডানে বাঁইয়ে মাথা ঝাকায় আর বলে, কেন আল্লাহর পথে চলবে, তিনি উনাদের জীবিকার ব্যবস্থা করবেন। আমি বললাম, আপনার কথাটা শুনে কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে রুজি করার মত শোনাচ্ছে। ধর্মেই না এর নিষেধ আছে? আর আমি তো তখন পুরাই ফর্মে, আরো জিজ্ঞেস করে ফেললাম, আপনার যে ৪ জন বাচ্চা, সবখানে প্রচার করা হচ্ছে, ছেলে হোক বা মেয়ে, ২ টি সন্তানই যথেষ্ট, আপনে কি বুঝে ৪ জন বাচ্চা নিলেন? সে খুব হেসে বলে, তুমি বাচ্চা মানুষ, এসব বুঝবে না, বড় হলেই বুঝবে। আমিও হেসে বললাম, বুঝিয়ে দিলেই না বুঝবো। তার স্ত্রী পাশ থেকে বলে উঠল, আমার ৪ বাচ্চা, কু্রআনের হাফেজ হবে, তারপর ৪ জোড়া হাত আমার কবরের পাশে হাত তুলে দোয়া করবে, আমাদের বেহেশত নসিব হলে, কার জন্যে হবে?

যাক, আমার এই প্রশ্নবানের ফলাফল খুবই ভয়ংকর ছিল, বাসায় বাবা মা ফেরার পর যথারীতি সালাম এসে আমার বাবার কাছে সকল কথোপকথনের বৃত্তান্ত শুনিয়ে গেলেন, রাতে আমাকে বেধরক মার খেতে হল বেয়াড়া প্রশ্নের জন্যে। আমার বাবা রাগ ছিল একটাই, আরেকজনের বাসায় গিয়ে তার আত্মীয়ের সাথে এই বাগাড়ম্বর কেন করেছি? যাক, পরে বাবা নিজেও খুব কষ্ট পেয়েছেন, আমাকে আমাকে পেদানি দেবার জন্যে, আসলে বিচার শুনতে হত প্রায়ই তাকে, কাজেই কিছু শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। আর ফলাফল টাও তেমনই ভয়ানক হত। আসল কথা হল, তখন আমার ইঁচড়ে পাকামি তিনি একদম পছন্দ করতেন না। আমাকে বয়সে ছোট দেখে মানসিক ভাবেও ছোট হিসাবেই গণ্য করতেন, আর আমার বাবা একা নন, সবাই এভাবেই দেখতেন আমাকে। যাক, এরপরে আমার পাশের বাসায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল, যতদিন উনারা ছিলেন, আমার জন্যে ঐ বাসা ছিল নিষিদ্ধ স্থান। চিকিৎসার পর সালাম ঢাকায় বদলি হয়ে যায়, এবারে সে শ্বশুর বাড়ির পাশে একখানা জায়গায় বাড়ি করে, ছোট্ট একখানা বাসা, শোবার একটাই ঘর। এদিকে তার মা একা একা ময়মনসিংহে থাকেন, তার মেয়ে তাকে দেখতে আসে মাঝে মাঝে, তার চাকুরি এখন বরিশালে। তিনি ও মাঝে মাঝে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে মাসখানেক থাকেন। কিন্তু ছেলের বাড়িতেও তিনি যান না, ছেলেও তাকে দেখতে আসে না, আসলেও একা আসে, সকালে এসে বিকালে চলে যায়।

১৯৯২ এ আমরা ঢাকা চলে আসি। আমি রেসিডেন্সিয়ালে ভর্তি হই, আর আমার ভাই বুয়েটে। সেখানে এসে কয়েকবার সালামের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। এর মাঝে খবর পেলাম, তার স্ত্রী আবার সন্তান সম্ভবা, আর তার ৪ ছেলেমেয়েই এখন মাদ্রাসায় যায়, তবে মেজ মেয়েকে তিনি বাসায় মেট্রিক পরীক্ষার বই পুস্তক দিয়ে পড়িয়ে পরীক্ষা দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন। তার বড় ছেলে মাদ্রাসায় কি এক পরীক্ষা দিয়ে হাফেজ হয় হয় অবস্থা। যেহেতু আমরা একা থাকি, কাজেই সালাম আসতো মাঝে মাঝে আমাদের দেখতে। মাঝে মাঝে সপরিবারে আসত, তবে এর মাঝে কয়েকবার তাকে আমি অংকের সমস্যা দেখিয়েছি, যে কোন সমস্যা নিয়ে তার কাছে গেলেই যেন বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ জ্বলে উঠত, অংক দেখেই বলে দিত, এর উত্তর এত। আমি মনে মনে বলতাম আহারে, কি জিনিয়াস একটা লোক। এর পরেও কয়েকবার পড়াশুনা বুঝে নিয়েছি তার কাছ থেকে, এত সুন্দর করে বুঝাতে পারে সে, মনে হয় যেন, এই সালাম আর সেই সালাম এক মানুষ নয়।

সালামের মা সালামকে বলে একবার, তোর ছোট ছেলেটাকে আমার কাছে দে, তোর সংসারে ৫ টা বাচ্চা, সবার যত্ন নিতে পারিস না ঠিকমত, এর চেয়ে আমি ছোট ছেলেটাকে স্কুলে দেই, আমার সাথেই থাকুক, ওর সকল খরচাপাতি নাহয় আমি দিব। তোর একটা ছেলেকে অন্তত স্কুলে পড়তে দে। কিন্তু কিসের কি, পুরা কিসিমের ঝগড়া হয়ে যায় মা ছেলেতে। ভাগ্যিস সাথে তার স্ত্রী ছিল না, থাকলে মনে হয় সে শাশুড়ির গলাই টিপে ধরত। তবে এমন প্রস্তাব দেবার জন্যে নানান কটু কথা শুনতে হয় তার বৃদ্ধা মাকে। সে এই বলে বের হয়ে আসে, আমাদের দেখার জন্যে উপরওয়ালা আছে, আপনার চিন্তা না করলেও চলবে। যার জন্যে এত কষ্ট করে তিল তিল করে মানুষ করল, সেই ছেলেই কিনা আজ মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যায়।

এর মাঝে সালামের অফিসে ছাটাই শুরু হয়, খবর আসে, বিএডিসি বলে কিছু থাকবে না। এরমাঝেও সালামকে কখনো একটু চিন্তিত হতে দেখিনি, পুরাই বিকারহীন একজন মানুষ। সবকিছুতেই উপর ওয়ালার ইচ্ছায়ই সব কিছু হবে, আমার কিছু করার নাই রকমের একটা ভাব। ব্যাপক হারে ছাঁটাই শুরু হয়, অনেকেই ঝরে পরে যায়, এতকিছুর পরেও সালামের চাকরি থাকে, তবে তার অফিসের অবস্থা খুবই করুন হয়ে যায়। কিন্তু এর মাঝেও তার তাব্লিগি চলতে থাকে পুরা দমে। আরো শুনি সে আর তার স্ত্রী হজ্জে যাচ্ছে, সাথে যাবে তার শশুর বাড়ির সকলে। আমি অবাক হয়ে বললাম, তা আপনি আপনার মাকে নিয়ে যাবেন না? সে নির্বিকার ভাবে বলল, না, আমরা তাব্লিগি দলে যাচ্ছি তো, এখানে থেকে হজ্জে যাবো, তারপর সেখানে থেকে লন্ডনে যাবো, তারপর আরো কয়েক স্থানে যাবার ইচ্ছা আছে, আল্লাহ যা রাখে কপালে। আমি আর আমার বড় ভাই ব্যাপক হারে গালাগালি করলাম সালামকে।

সালাম হজ্জে চলে যায়, তখন ১৯৯৭ সাল, আমার এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ, কোরবানির ঈদের ছুটিতে দেশের বাড়ি গিয়েছিলাম, ফিরে এসেছি, এক সপ্তাহ পড়ে ব্যবহারিক পরীক্ষা, এর মাঝে খবর আসল, সালামের বড় মেয়েকে কে যেন পিস্তল দেখিয়ে তুলে নিয়ে গেছে বাসা থেকে। তার বোন তখন বদলি হয়ে ঢাকায় চলে এসেছে। কিন্তু সালাম তার ছেলেমেয়েকে সেখানে রেখে যায় নি, রেখে গেছে তাদের এক তাব্লিগি দলের বাসায়। সেখান থেকে এ ঘটনা ঘটেছে। পাড়ার মাস্তান এসে বলে তাকে তুলে নিয়ে গেছে। আমরা তো শুনে থ'। হাজার হলেও এরা পুরাই পর্দানশীল পরিবার, পাড়ার মাস্তান এই মেয়েকে দেখলই বা কিভাবে আর খোঁজ পেল কিভাবে যে কোথায় আছে? সালামের বোনের জামাইয়ের পুলিশি বন্ধুবান্ধব যারা ছিল, তাদের সকল সুতাটানাটানি শুরু হল, পাড়ার মাস্তানের বাবা মা কে পুলিশ ধরে আনল, সে নাকি পাড়ার মদ বিক্রেতা। আরো মজার খবর বের হল যে, তাদের ভাষ্যমতে, তার ছেলে তার প্রেমিকাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এমন কিছু শুনলেই বিশ্বাস করা যায় নাকি? কিন্তু ছেলের বাবা মা ছবি বের করে দেখায়, অর্থাৎ এই বোরখা ওয়ালি নিনজা বোরখার নিচে কি খেমটা নাচটাই না নেচেছে। আরো বের হল, সালামের মেয়ের ডায়রি। সেখানে বেশ নাটকিয় ভাবে এই মেয়ে লিখেছে তার বিভিন্ন মনোবাসনা।

২দিন পরে পুলিশ সালামের মেয়েকে উদ্ধার করে আনে এক গ্রাম থেকে। এর মাঝে সালামের দুলাভাই তো রাগে খালি গর্জন করে যাচ্ছে, আর কিছুই তো করার নেই তার। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি সালামের কাছে খবর পাঠান, যেন তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সাথে যোগাযোগ করেন। প্রায় আরো ২ দিন পর সালাম মক্কা থেকে ফোন করে, তারপর জানতে পারে তার গুনবতী কন্যার গুনাবলীর বিস্তারিত বর্ননা। এরপর সে মক্কা থেকেই সরাসরি দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয় শুধু তার স্ত্রীকে নিয়ে। মজার বিষয় হল, তার বাসায় কোন টিভি ছিল না, ছিলনা কোন বেয়াড়া গল্পের বই, ছিল শুধুই একনিষ্ঠ ধর্ম বিশ্বাস। ফিরে এসে সে এলাকা ত্যাগ করে অন্য এক এলাকায় বাসা নেয়, তারপর তাড়াতাড়ি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয় এক বিদেশগামী ছেলের সাথে। যতদুর জানি সেই মেয়ে এখন বছর ঘুরতেই একজন করে মানব শিশুর জন্ম দিয়ে যাচ্ছে, কারন তার বিয়েও হয়েছে তাব্লিগি দলের এক অনুসারীর সাথে।

সালাম হজ্জ থেকে ফিরে আসলে তার মা তাকে ডেকে পাঠায়, তার ডাকে সাড়া দিয়ে সে আর তার স্ত্রী হাজির হয়। বেচারি খুব দুঃখের সাথেই বলেন, তোরা এমন একটা কাজ করলি, জানতি যখন তোর মেয়ে পাড়ার এক মাস্তানের সাথে প্রেমে পড়েছে, সেটা জানিয়ে তোর মেয়েকে আমার কাছে রেখে যেতে পারতি, আমার জান থাকতে ওকে কেউ তুলে নিয়ে যেতে পারত না। এর জবাবে বারুদের মত জ্বলে উঠে স্বামী স্ত্রী, যা তা বলে বকাবকি করে বৃদ্ধা মাকে, এক পর্যায়ে তার স্ত্রী বলেই ফেলে, আমার মেয়েকে দরকার পড়লে আমি কেটে পানিতে ভাসায় দিব, তাতে আপনের কি? আমাদের যেখানে যেভাবে ইচ্ছা, সেখানে সেভাবে আমাদের মেয়েকে রাখবো, তাতে আপনার কি? এই শুনে সালামের বৃদ্ধা মাতা একেবারেই চুপ মেরে যান, পরে জানতে পেরেছিলাম, তিনি প্রায় ৪ দিন দানাপানি স্পর্শ করেন নি, তার মেয়ে অনেক বুঝিয়ে তার মন নরম করিয়েছিলেন, কিন্তু তারপরে আর তিনি কখনো তার ছেলেকে বা ছেলের বউকে উপদেশ দিতে যান নি। আমার আমরা জানতে পারার পর আমার বাবা কে জানিয়ে দিয়েছিলাম তিনি যেন আমাদের বাসায় না আসেন, আসলে দাড়ি কেটে মাথা মুড়িয়ে ছেড়ে দিব আমরা ২ ভাই মিলে।

এর মাঝে সালাম কয়েকটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করার চেষ্টা করে বিকালে। কিন্তু দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করতে করতে তার গায়ে যেন জং ধরে গেছে, বেসরকারি চাকরির ধকল যেন তার সহ্য হয় না। আবার অন্যদিকে তার সরকারী চাকরিও এখন তখন যায় যায়। কিন্তু এত কিছুর পরেও তার কাকরাইল মসজিদের কাজকর্ম একই গতিতে চলতে থাকে, বয়সের কারনে চিল্লার পরিমান কমতে থাকে। এর মাঝে তার বড় ছেলে হাফেজ হয়ে গেছে, আর ছোট ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে, সেজ মেয়েও মাদ্রাসায় পড়ে আর একদম ছোট্ট (পঞ্চম) মেয়ে তখনো কোথাও ভর্তি হবার বয়স হয়নি। ভাগ্যিস পঞ্চম মেয়ে হবার সময় তার স্ত্রীর জরায়ুতে টিউমার দেখা যায়, ফলে বাচ্চা হবার পরেই তার জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়, নাহলে দেখা যেত, আমার মেয়ের পাশে উনার বাচ্চাও দৌড়ে বের হচ্ছে, যে দেশে জনসংখ্যা একটি জাতীয় সমস্যা, সে দেশে একজন শিক্ষিত মানুষ বছর ফিরতেই নতুন মুখ আনে কি করে আমি এখনো বুঝে পাই না। অবশ্য অন্যের জীবন নিয়ে এভাবে মন্তব্য করা ঠিক না, কিন্তু কিভাবে যেন সকলের অপছন্দের কাজ গুলি আমি ঘটা করে করে থাকি।

সালাম এখনো বিএডিসিতে আছে, সততার নিদর্শন স্বরূপ তার চাকরি যায় নি, তবে অবসর নেবার সময় চলে এসেছে, তার বর ছেলে বিয়ে করেছে, সেই তাব্লিগি নেটওয়ার্কেই। আমি দিন গুনছি, কোন একদিন শুনব, সালামের পুত্রবধু সন্তান সম্ভবা, তারপর সেই পুরানো চক্র আবার শুরু হবে। তবে, এখন সালাম মোটামুটি ঘরকূনো হয়ে গেছে, বয়স তো আর কম হয় নি, আগের মত দৌড়াতে পারে না। তার মা এখনো বেঁচে আছেন, সোজা হয়ে দাড়াতে পারেন না। স্মৃতি শক্তির অবস্থাও খুব করুন। আমাকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন, তবে আমি বিয়ে করেছি শুনে খুব অবাক হয়েছেন। আমার বাচ্চাও আছে শুনে আকাশ থেকে পড়েছেন। তিনি এখনো একা থাকতেই পছন্দ করেন, বছরের অর্ধেক সময় থাকেন ময়মনসিংহ আর বাকি অর্ধেক সময় থাকেন তার গ্রামের বাড়িতে।

জানি না সালাম নিজেকে নিয়ে কি ভাবে, কিন্তু আমি দেখি একজন সত্যকারের প্রতিভা, যিনি হয়ত দেশকে সত্যি কিছু দিতে পারত, কিন্তু কোথা থেকে তার জীবনটা কোথায় চলে গেল। হয়ত শিক্ষক হয়ে তার অসাধারন ক্ষমতাগুলো ছড়িয়ে দিতে পারতো আরো শত থেকে হাজার খানেক প্রতিভাবানদের মাঝে। জানতে ইচ্ছা করে, বিবেকের কাছে সালামের অনুভূতিটা কি রকম? দৈনিক জীবনের কোন কিছুই কি তাকে স্পর্শ করে না? অন্তত দায়িত্ববোধের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গিটা কি? একজন স্বামী হিসাবে, একজন বাবা হিসাবে, একজন ছেলে হিসাবে, একজন ভাই হিসাবে, একজন প্রকৌশলী হিসাবে অথবা সব বাদ দিয়ে এই দেশের একজন মানুষ হিসাবে? অবশ্য এ প্রশ্ন গুলো শুধু সালাম কে না, সবারই করা উচিত নিজেকে।

No comments:

Post a Comment