Monday, October 19, 2009

ছিদ্রান্বেষী

অনেকদিন কিছু লিখি না, নানান রকমের ঝামেলা এসে মাথায় ভর করেছে একসাথে, প্রতিদিন ভোর ৫টায় উঠে দৌড়াতে হয় দূরে এক হাসপাতাল, ১ ঘন্টার রাস্তা উড়ে যাই যেন ৪৫ মিনিটে, আর আল্লাহ-বিল্লাহ করি, যেন মামু না ধরে। এর মাঝে সবাই অনবরত জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছেন লেখি না কেন। রোজ বাসায় ফেরার পথে ভাবি, আজ গিয়ে কিছু লেখব, কিন্তু বাসায় এসে কোনমতে দিনের প্রথম ভাত গলাধ:করণ করে মেয়ের সাথে কতক্ষণ খুটুর মুটুর করে আবার ঘুম দেই, লেখব কখন? তারমাঝে সচলে বেশ কয়েকদিনে কোমর বেধেই যেন ঝগড়া করলাম কয়েকজনের সাথে। একজন তো আবার আর এক লেখা পড়েই আমার চরিত্র বিশ্লেষণ করে ফেলল। যাক, প্রথম সুযোগেই আবার অপরের বদনাম শুরু করেছি। মানুষের ছিদ্র খুঁজতে কেন যেন ব্যাপক মজা লাগে। কোথাও কাউকে পেলেই হেঁড়ে গলায় বদনাম শুরু করে দেই। তাই ঠিক করলাম, বেহুদা মানুষের ছিদ্র অন্বেষণ না করে নিজের ছিদ্রই খুঁজি না কেন?

আমি নিজেকে খুব রসিক মনে করি, সবাইকে নানাভাবে যন্ত্রণা দিতে পারলে আমার বিটকেল দাঁত থেকে আলাজিহ্বা পর্যন্ত সবই বের হয়ে যায়, কিন্তু দেখা যায়, অন্যকেউ সেই রসিকতা করলে প্রায় সময়ই সেটা গ্রহণ করতে পারি না, গরম কড়াইয়ে পানি পড়লে যেমন ছ্যাঁত করে লাফিয়ে উঠে, আমিও যেন সেভাবেই সমালোচকের ঘাড়ে চড়ে বসি। তারপর আবার বনমানুষের মত বুকে বাড়ি দিয়ে বলি, আমার চামড়া অনেক মোটা, কারো কথায় আমার কিছু আসে যায় না!!

কাজের সুবিধার্থে ধুমধাম মিথ্যা কথা বলি, এমনকি চোখের পাতাও পড়ে না, এমন হয়েছে যে, যার সাথে চাপা মারছি, তাকে নিয়েই হয়ত চাপা মারছি, এক পর্যায়ে সেও দ্বিধান্বিত হয়ে যায়, আসলেও সত্যি নাতো? অবশ্য বেশীর ভাগ সময় তা মজা করার জন্যই করে থাকি। তবে মজা বেশী হয় যখন আমার মারা চাপা, চামের উপর বামে দিয়া লেগে যায়। একটা উদাহরণ দেই, তাহলে বুঝবেন, আমার শালীর এক দোস্তের সাথে অন্তর্জালে বকবক করছি, আজাইরা প্যাচাল পারতেছি, কথা বলতে ইচ্ছা করতেছে না, নানা ভাবে ইংগিত দেবার পরও যায় না। হঠাৎ মাথায় দুষ্টামি ভর করল, বললাম, "শুনলাম, তোমার বয়ফ্রেন্ডের বলে মাথায় সমস্যা" যেহেতু আমি জানি, ঐ মেয়ের বয়ফ্রেন্ড নেই, কাজেই আমি জানি সে হেসে উড়িয়ে দিবে, সে তো ঐদিকে মহা গম্ভীর, আর কথা বলে না, খালি একই প্রশ্ন, কে বলল আপনাকে? অমুকে বলেছে? তমুকে বলেছে? তারপর আমার শালীকে অন্তর্জালে পেতেই তাকে আক্রমন, একটু পরে আমার শালী ফোন করেছে, আপনে কি বলেছেন "____" কে, আমাকে দোষ দিচ্ছে, যেন আমি বলে দিয়েছি, ঢাকা থেকে ফোন করতেছে একটু পরপর। আমি তো হাসতে হাসতে শেষ।

নোটিস দিয়ে বাসায় হাজির হয়ে ভাত খেয়ে বের হওয়া মনে হয় আমার মহৎ গুনাবলীর মধ্যে আরেকটা, আর এই গুনের ফলাফল ভোগ করেছে আমাদের মৃত্তিকা সহ আরো অনেকেই। কেউ রাঁধতে না পারলেও মাফ নাই, অফিস থেকে গাড়ি করে তুলে নিয়ে খাবারের দোকানে গিয়ে হাজির। তারপর জিজ্ঞেস করব, কি খাবা? তারপর বিল দেবার সময়, ইয়ে মানে, আমার কাছে ক্যাশ নাই, বিলটা একটু দিতে পারবা? এমন শিকারে পরিণত হয়েছে মনে হয় সবচেয়ে বেশী অনিকেতদা।

রাঁধতে পারি না কিছুই, অথচ খাবার সময়, নাক সিঁটকিয়ে বলে ফেলব নির্লিপ্তভাবে, "এহ হে, খাবারে লবণ বেশি হয়েছে বা কম হয়েছে" অথবা, "ধুর এইটা কি কোন রান্নার জাত হল, মুখেই দিতে পারছি না", অথচ নিজে রান্না করলে ধুরুম ধারুম প্লেটে উঠিয়ে দিব, আর মুখ ফুটেও বলব না, আমি রান্না করেছি, পাছে যদি কেউ না খায়। হাবিজাবি রান্নার প্রায়ই অপচেষ্টা করতে থাকি, আর এই যন্ত্রনার শিকার হয় আমার স্ত্রী। বেচারী আগে মুখে দিত, আমার চিকেন মারসালা (মারসালা ওয়াইন দিয়ে জ্বাল দিতে হয়, ভাজি করার পর) খাবার পর থেকে পথ ভুল করেও আর এসব মুখে দেয় না। আমি যেসব জিনিষ খাই, সেগুলাই যেন দুনিয়ার সেরা খাবার, যেটা খাইনা, সেটা আমার সামনে কেউ খেলে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপে ব্যাপকভাবে নাজেহাল হতে হয়। যেমন, সেদিন কাকড়ার শেদ্ধ ঠ্যাঙ নিয়ে বসলাম, প্লায়ার দিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে খাচ্ছি, আর আসে পাশে বসা সবাই তটস্থ হয়ে আছে, কখন সেই পানি গিয়ে গায়ে লাগবে, অথচ আমার কোন বিকার নাই।

রান্না নিয়ে আরেকটা ঘটনা বলি, যেটা আমি খাইনা, কেউ আমাকে জোর করে খাওয়াতে পারবে না, আমার স্ত্রী আর শাশুড়ি এপর্যন্ত আমাকে খাইয়ে শান্তি পেল না, কারন উনারা যেসব পছন্দ করেন, আমি সেসব খাইনা। আমার স্ত্রী পটল আর সাজনা খায় না, এই নিয়ে কত যে কথা শুনালাম, ২-৩ বার ভুং ভাং দিয়ে খাইয়েও দিয়েছি পটল। যাক, এদিকে আমার স্ত্রী গরুর জিহ্বা খায় না, খাওয়া তো দুরের কথা, দেখলেই তার বমি পায়। তার মনে হয়, একটা গরু দাড়িয়ে হাম্বা হাম্বা করতে করতে জিহ্বা বের করেছে, আর আমি লাফিয়ে গিয়ে কামড়ে ধরেছি গরুর জিহ্বা, দুর্ভাগ্যবশত গত ৪ বছরে আমি সন্ধান পাইনি জিহ্বার, হঠাৎ সেদিন শপ-রাইট নামের এক বিপনীবিতানে গিয়ে দেখি, বিশাল বিশাল গরুর জিহ্বা। স্ত্রী সাথে যায়নি, এই সুযোগ, চুপচাপ কিনে এনে সোজা ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তারপর নানা কসরত করে রান্না করেছি। আমি খুব ভালো ভাবেই জানি, আমার স্ত্রী আমার অপছন্দের কিছু রান্না করতে গেলে বাসা মাথায় তুলে ফেলতাম। এজন্যে আমি আমার স্ত্রীর ধৈর্যের কাছে চিরঋণী। সেই সুযোগে আমি আবার ইদানিং তাকে সাধাসাধিও করি জিহ্বা খাবার জন্যে।

আমাকে আপন কেউ যদি কিছু বলেন, তখনই সাথে সাথে ঘাড়টা ত্যাড়া হয়ে যায়, যত ভালো কথাই বলুক না কেন! যেই বাইরের কেউ সে কথাটা বলে, তখন যেন এই শূন্য নারিকেলের খোল ভেঙ্গে শব্দ মাথায় ঢোকে, আমার প্রিয়জনেরা আমাকে হজম করেন কিভাবে, সৃষ্টিকর্তাই মনে হয় জানেন। আর তর্ক করার কথাতো বল্লামই না। কারনে অকারনে তর্ক করে আগে ব্যাপক মজা পেতাম, এখন আর পাই না। কিন্তু এসব ছিদ্রতো অতিশয় ছোট, সবচেয়ে বড় ছিদ্র হল আমার রাগ। কাথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই রাগ উঠে যায় আমার মাঝে মাঝে, বা বেমক্কা কেউ যদি ধাক্কা দেয়, আর আমার চশমা যদি বেসামাল হয় তাতে, তাহলে কথাই নেই। কদিন আগে বাসা পাল্টালাম, বাক্স নামাচ্ছি একা একা, সিড়িতে বাক্সের গুতা লেগে চশমা পড়ে গেল, এমন রাগ উঠল যে কি বলব। নিজের সাথেই ব্যাপক খিস্তি খেউড় শুরু করলাম, পাশের বাসার মহিলা দৌড়ে চলে এসেছে, কাকে খিস্তি দিচ্ছি দেখার জন্যে। অনেক সময় খিস্তি হয়ত দেই না, কিন্তু হঠাৎ করেই মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে যায়, তখন সামনে যে থাকে, ২-১ টা বিশ্রী ধমক অন্তত জুটে।

গাড়ি চালাতে গেলে রাগ খুব একটা উঠে না, চাপ দিলে বেশির ভাগ সময় পাল্টা চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকি বা থাকার চেষ্টা করি। যারা আমার মামদোবাজি সিরিজ পড়েছেন তারা জানেন ৫নং এর ঘটনা। এরপর থেকে চাপ খেয়ে চাপ দিতে পাগল হয়ে যাই না। কিন্তু তারপরেও রাগের বহি:প্রকাশ হিসাবে গাড়ি শিকার হয়েছে বহুবার। দেশ থেকে "সুইডেন ফিরোজ" আসল ডেলাওয়ারে, ব্যাটা একটা আস্ত গাড়ল। তার গল্প নাহয় আলাদা করে লেখব। যারা বুয়েটের ছাত্র তারা মনে হয় আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবেন আমার ঐ লেখার দেবার পর। যাক, তাতে কোন সমস্যা নাই। তিনি বু্যেটে বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান। ইনার স্ত্রীকে আর ২ মেয়েকে নিয়ে গেলাম আমাদের শহরের মলে, তারা জানেন যে, রাতে আমাদের নিউ ইয়র্ক যেতে হবে, আমি উনাদের কতক্ষন ঘুরার পরে বললাম, আমি গাড়ি নিয়ে J C PENNY এর সামনে দাড়াচ্ছি, আপনারা ১৫ মিনিটের মাঝে চলে আসেন। আমি বাইরে গিয়ে এসে দাড়িয়ে আছি, সিকিউরিটি এসে আমাকে কয়েকবার তাড়িয়ে দিল, কিন্তু এই ভদ্রমহিলার আর কোন খবর নেই, আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করে তাড়া দিচ্ছি, আর সে বলে, এইতো ৫ মিনিট। এভাবে ৪৫ মিনিট যখন পার হয়েছে, তারা এসে হাজির গেটে। এরপর তাদের গাড়িতে উঠিয়েই ধুন্দুমার টান, পুরা ঢাকাই ফ্যাশানে টান। তিনি নানা রকমের দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করলেন, আমাকে কয়েকবার উপদেশ দেবারও চেষ্টা করলেন, এদিকে আমার স্ত্রী চুপ, কারন সে তো জানে, ঘটনা, খারাপ। আমি মলের পার্কিং লট থেকে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে ২ গাড়ির মাঝে খান দিয়ে সাই করে টান দিয়ে গিয়ে আই-৯৫ এ উঠলাম, তারা পোঁ পোঁ করে হর্ণ বাজালো, তাতে কি আমার রাগ পড়ে? আই- ৯৫ এ উঠেই একটানে ৯০ মাইল, তারপর এর ওর ফাঁক দিয়ে সাই সাই করে ওভারটেক করতে থাকলাম। বাসায় এসে যখন নেমেছি, চারদিকে টায়ার পোঁড়া গন্ধ, আর পেছনে বসে মা-মেয়ে ৩ জনের গা হাত-পা ঘেমে গিয়েছে। এরপর তারা আর আমার গাড়িতে উঠে নাই।

চলবে?

No comments:

Post a Comment