কালকে দ্রোহীদা আর কিংকু চৌধারির সাথে খোমাখাতায় বকবক করতে গিয়ে মনে পড়ে গেল সেই মধুর স্মৃতিগুলো, নানুর চোখ ফাঁকি দিয়ে সেবার বই পড়া আর নানা ফন্দিতে মাসুদ রানার বই সংগ্রহ করা, এখন পিছন ফিরে দেখতে গিয়ে দ্বীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। সেবার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় সেবা রোমান্টিক সিরিজের মাধ্যমে। বইয়ে নাম ছিল সম্ভবত ‘নিষিদ্ধ প্রেম’, গল্পের চরিত্র ছিল বাদল, যে কিনা তার চাচীর সাথে থাকে, আর তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। প্রথম পড়ি মনে হয় সপ্তম শ্রেণীতে থাকতে। সে রকম ছিল বইয়ের কাভার। তখন আমি রাজশাহীতে থাকি, বইটা হাতে আসে আমার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে, এর পরে পড়ি “ব্রাম স্টোকার এর ড্রাকুলা”, এক পর্যায়ে গিয়ে এতটাই ভায় পেয়েছিলাম যে, ভাইয়ার পাশে বসে পড়েছি বাকিটা। কি অসাধারন সেই অনুবাদ গুলো, ভাবলে মন উদাস হয়।
রাজশাহীতে থাকতে কেন যেন মাসুদ রানার সাথে সাক্ষাত হয়নি, অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার পরে ঢাকা চলে আসি আমি আর আমার ভাইয়া। আমার বাবা-মা চলে যান বরিশাল চাকরির টানে বদলি হয়ে। আমার ভাইয়া তখন বুয়েটে ভর্তি হয়েছেন। আমরা ঢাকায় এসে উঠি পশ্চিম রাজাবাজারে ছোট্ট একটা বাসায়। ঠিক হল, আমি ঢাকায় রেসিডেন্সিয়াল মডেলে ভর্তি হব, যেহেতু তারাই একমাত্র পুরোপুরি আবাসিক। ঢাকায় এসে আমার স্কুল নাই, কিছু নাই, সারাদিন সিনেমা দেখার বাতিক হল। একটানা ৫-৬টা করে সিনেমা দেখতাম। পাড়ায় কোনার ভিডিও দোকানে গিয়ে ৩-৪ টা সিনেমা আনতাম, তারপর দেড় ঘন্টা পরে গিয়ে একটা পালটিয়ে আনতাম, বলতাম, এটা পছন্দ হচ্ছে না। যাক, এভাবে ধানাই পানাই করে দিন কাটাচ্ছি, এর মাঝে হাতে আসল আরব্য রজনীর ৯টা বইয়ের সিরিজ। তখন আমার নানু থাকেন আমাদের ২ ভাইয়ের সাথে।
তার সামনে তো আর এই বই পড়তে পারি না, বইয়ের উপরে বড় বড় করে লেখা, প্রাপ্ত বয়ষ্কদের জন্যে। মহা বিপদ, বইয়ের মাঝে রেখে রেখে পড়ি, নানুকে দেখলেই লুকাই, এভাবে পড়ে যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ করে মাথায় বুদ্ধি এল, বাথ্রুমে ঢুকে পড়লাম, আধাঘন্টা পরে নানু যখন এসে বলল, কিরে, এখনো ভিতরে? আমি বললাম, “পেট খারাপ”। কিন্তু একই বুদ্ধিতো আর রোজ খাটে না। রোজ রোজ নানান ফন্দি ফিকির করতে থাকি, অপেক্ষা করি, কখন নানু ভাত খেয়ে ঘুমাবে, তখন খোলা ময়দানে আরাম করে পড়ব বই। ভুং ভাং করতে করতে চলে আসে বার্ষিক পরীক্ষা, তার লেজ ধরে ভর্তি পরীক্ষা, পরীক্ষায় উতরে যাই, ভর্তি হয়ে যাই নবম শ্রেনীতে। এখানে এসে বন্ধুত্ব হয় রনি নামে ২ জনের সাথে। একজন ভাঙ্গা রনি, অন্যজন বিড়ি রনি। বিড়ি রনি একদিন হঠাৎ করেই একখানা মাসুদ রানা এর বই নিয়ে হাজির, শেষের বেঞ্চে বসে রনি পড়তে থাকে, আমার ও খুব আগ্রহ হয়, নিয়ে আমি পড়ার চেষ্টা করি, কিন্তু ঠিক ধরতে পারি না, কোথা থেকে কোন দিকে যাচ্ছে ঘটনা। সেদিন ধর্ম ক্লাসে আমাদের হেড মওলানা স্যার সেই বইটা হস্তগত করেন, তারপর নিজে পড়তে পড়তে নিজের রুমে ফেরত যান।
কি কারনে জানি না, কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা হল, কি এমন বই যে, স্যার মেরে নিয়ে নিজেই পড়তে লাগল। বাসায় ফেরার পথ ফার্মগেটে একটা বুক্সটল থেকে কিনে ফেললাম “হ্যালো সোহানা”, আমার পড়া প্রথম মাসুদ রানা। সেই যে শুরু হল, পড়তে গিয়ে বারবার হোচট খেতে লাগলাম, অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে, যার কোন হাতামাথা নাই। যাক, পরেরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে গেলাম ফার্মগেট, গিয়ে কিনলাম ১-২০, ধ্বংস পাহাড় থেকে জাল। ধ্বংস পাহাড় পড়েই তো আমি পুরা কাইত। আহা! কি বই! তখন থেকে আমি কবীর চৌধুরির বিশাল ফ্যান হয়ে গেলাম। ১-২০ পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি, তখন তো স্কুলে সারাদিন মাসুদ রানা, বাসায় ফিরেও সেই একই কথা। আর হায় হায় করতে থাকি, এতদিন কি করেছি, কত বই বের হয়ে গেছে। তখন মনে “আমি সোহানা বের হওয়া শেষ বই। কিন্তু আমি তো পুরাই নেশাগ্রস্তের মত পড়ে যাচ্ছি। তারপর আবার গিয়ে হাজির হই ফার্মগেট, তেজগাও কলেজের গেটে একটা বুক্সটল আছে, সেখান থেকেই কিনতাম সব বই। ততদিনে আমার চেহারা চিনে ঐ দোকানি, গেলে আমাকে সেবার একটা লিস্ট দেন, যত বই বের হয়েছে, তার, সেটা থেকে আমি বলি ২১-৫০ পর্যন্ত যেটা যেটা আছে, সেই বই গুলা দেন। সে মাথা চুলকে বলে, আসলে এখানে অনেক বই নাই, মানে হয়ত ২৯-৩০-৩১ একসাথে, কিন্তু, ৩০ নাই, ছাপায় নাই সেবা প্রকাশনী বহুত দিন।
আমার মাথায় হাত দেওয়া ছাড়া আর কিছু কতার থাকল না, ভেবেছিলাম, সিরিজ ধরেই পড়ব, কিন্তু কি করা, বললাম, যেগুলা সেট আছে, সেগুলা দেন। এইভাবে প্রথম ৭০ টা বই কিনি ৩ ধাপে। হাতে খুব বেশি টাকা থাকে না, এজন্যে একবারে বেশি বই কিনতে পারতেছি না। এই ৭০ টার মধ্যে কম করেও ২০ টা বই এর ফাঁক ছিল। কিন্তু, আমি নিরুপায়, এর মাঝে ফেব্রুয়ারী মাস আসল, আমি গেলাম সেবা প্রকাশনীর স্টলে, এরা অনেক ডিস্কাউন্ট দেয় দেখে এখান থেকো কিছু বই কিনি, আর ঐ ২০টার মধ্যে থেকে, বেটারা বলে, তাদের কাছেও নাই ঐ বইগুলা। মনে মনে গাল পাড়তে পাড়তে বাসায় চলে আসি, আর মাসে ১ বার করে যেতে থাকি ফার্মগেটের ঐ স্টলে, এভাবে গড়ে উঠতে থাকে আমার কলিম রানা থুক্কু মাসুদ রানার সংগ্রহ। কিন্তু এর ফাক ফোকর দিয়েও কত বই বাদ পড়ে যেতে থাকে, সেবা ছাপে না, দোকানদারের কি দোষ? আমিও প্রতিবার গিয়ে লিস্ট আনি, এনে আগের লিস্টের সাঠে মিলাই, কাটাকাটি করি।
ফুফাতো ভাই আমার মোট ১৫ জন, একজন আমার ১ বছরের ছোট, সে বুদ্ধি দিল, নিলক্ষেত গিয়ে খোজাখুজি করার, তাকে নিয়েই গেলাম, ভাগ্যক্রমে খুজে ৮টা বই পেয়ে গেলাম ফুটপাতের বিভিন্ন দোকান থেকে, সে সময় আর নতুন পুরান, পরিষ্কার ময়লা বুঝি না, সিরিজ শেষ না করে শান্তি পাচ্ছি না। তারপর প্রায় আরো ২ বছর লেগে যায় আমার ২৫০ বই কিনতে। কিছু ফাঁক তখন ও আছে, কিন্তু, যা কিনেছি, সব বই পড়ে ফেলেছি, কাজেই আবার শুরু থেকে শুরু করার ইচ্ছা হল, কিন্তু, এর মাঝে মেট্রিক পরীক্ষার প্রিটেস্ট এসে হাজির। কাজেই পাজী আনোয়ার হোসেন কু-ডাক উপেক্ষা করে মাসুদ রানার মুখে বোরখা পড়িয়ে ধুমসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকি। প্রিটেস্ট শেষ হয়, কিন্তু তখন পরীক্ষায় ভয় ঢুকে গেছে মনে। কাজেই টেস্টের আগ পর্যন্ত সকল মাসুদ রানা বাক্সবন্দি করে রাখি, যাতে করে নেশার বশে আবার শুরু না করি।
টেস্ট শেষ হবার পরেই ফার্মগেট গেট হাজির হই, আর লিস্ট মিলিয়ে যা পাই, কিনে ফেলি, তখন আমার এমন অবস্থা, দোকান্দারকে বলি, সেট হওয়া লাগবে না, ২ খন্ডের ১ টা থাকলে সেটাই দিন। এভাবে আমি প্রায় ২৫০ এর মধ্যে থেকে ২৪০ টার মত বই সংগ্রহ করতে সমর্থ হই। আর অপেক্ষা করতে থাকি, কবে বইমেলা শুরু হবে, সেবা নতুন করে পুরান বই ছাপবে, হয়ত সেখানে আমার না থাকা বইগুলাও পাওয়া যাবে। সেখানে গিয়েও আধাখেচরা করে বই কিনতে থাকি, আর অসম্পুর্ন ভাবে গল্পের ১ পর্ব পড়ে নিজেকে গালি দিয়ে ভুত তাড়ানোর অপচেষ্টা করতে থাকি। আর নিলক্ষেতের আশে পাশে গেলেই ফুটপাতে চোখ রাখতে থাকি, ততদিনে আমার মানিব্যাগে একটা লিস্ট এসে গেছে, যে ১০ টা বই নেই, তার নাম নিয়ে নিয়ে ঘুরি, কোথাও যদি পাওয়া যায়। বইয়ের পিছনে যখনই চিঠিপত্রে আগের বইয়ের উল্লেখ থাকত, তখনই মেজাজ খারাপ হয়ে যেত, যে এই বইটাতো পড়ি নাই এখনো।
মাসুদ রানার বাজারে পাওয়া সব বই শেষ, এখন কি করি, এর মাঝে চোখে পরে কুয়শা, আর কিছু না, খালি কাজীদার নাম দেখেই কিনে ফেলি ৫টা সমগ্র। কুয়াশার সমগ্র ১-২-৩, ৪-৫-৬ এভাবে ছাপানো। প্রথম গল্পটা পড়েই আমি বুঝে যাই, এ তো আমাদের কবির চৌধুরির “যদি সফল হত” আর “পরোপকারী” হত, তাহলে কেমন হত! কুয়াশার ৭৬ টা বই মনে হয় এক নিঃশ্বাসে পড়েছি, এতই ভালো লেগে গেল যে, শেষ করেই আবার শুরু থেকে শুরু করি। প্রথম পড়ায় যদি মজার কিছু বাদ পড়ে গিয়ে থাকে। মজার কথা হল, কুয়াশা সিরিজ কিন্তু মাসুদ রানার ও আগে শুরু করা। পাকি আমলে কাজীদা ১৯৬৬ সালে লেখেন প্রথম কুয়াশা, তারপর মাসুদ রানার প্রথম বই ধ্বংস পাহাড় লেখেন সম্ভবত ১৯৬৭ সালে। নতুন রানা আসছে না, এ দিকে কুয়াশা লেখা বন্ধ করেছেন কাজীদা ১৯৮৪ সালে। মনে মনে বলতে থাকি, এই ব্যাটার থামার আর সময় জুটলো না। আর বছর পাঁচেক লিখলে কি অসুবিধা ছিল?
এর পরে ধরে ৩ গোয়েন্দা, রকিব হাসান মিয়া আসলে দুধভাত, কুয়াশা আর রানা পড়ার পরে কেমন পান্সে পান্সে লাগত। কিন্তু সেবার টানেই বার বার ফিরে ফিরে আসতাম আর আবাল ৩ গোয়েন্দা পড়তাম। তবে প্রথম ৬০টার মত ৩ গোয়েন্দা বেশ ভালোই ছিল, তবে তারপর কেমন যেন পেট খারাপ হয়ে গিয়েছিল রকিব হাসানের। কোন ভাবে জোড়াতালি দিয়ে কোন মতে বই দাড় করাতে পারলে যেন বর্তে যাবেন তিনি। ১০০ এর পরে আর সম্ভব হয়নি ৩ গোয়েন্দা হজম করা। কাজেই সেটা বাদ দিয়ে আবার মাসুদ রানা শুরু করি, পরের বারের বই মেলায় গিয়ে দেখি, সেবা সব বই আবার ছাপানো শুরু করেছে। কি মনে করে রানা ১-২-৩ তুলে নেই, পরতে থাকি স্টলে দাড়িয়েই, ১ পাতা পড়তেই কেমন যেন লাগতে থাকে। বুঝতে পারি, রানা তে প্যারেন্টাল গাইডেন্স বসানো হয়েছে। কার উর্বর মস্তিষ্কের থেকে এই বুদ্ধি আসল, কে জানে? এই বই মেলায় আর কোন ফাঁক থাকে না, সব বই পেয়ে যাই।
একটা জিনিষ আমাকে খুব বিরক্ত করেছিল, সেটা হল, মাসুদ রানার বয়স যদি স্থির থাকে, তাহলে তার বন্ধু সোহেল, তার বস রাহাত খান কেন বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন, আর আরেকটা জিনিষ হল যে, অমুক সময়ে সে কেউকে সাহায্য করেছে, তার ছোট বোন ছিল, ঘটনা চক্রে আমাদের রানা সেই মেয়ের সাথে প্রণয়ক্রিয়াতে লিপ্ত হচ্ছে, আগে ছোট ছিল, এখন বড় হইসে, আমি তো বড় হই নাই, এমন একটা ভাব। কতটা জরুরী ছিল এই ভাবে লেখার? আর স্পাই মানুষ, বনে জঙ্গলে তার ঘুরে বেড়ানো মানায় না, কিন্তু অনেকবারই সে ফিরে গেছে আফ্রিকার জঙ্গলে, সম্ভবত, কাজীদা তখন কোন গল্প খুজে পাচ্ছিলেন না, কিন্তু বই বেরুলেই মানুষ কিনবে, তাই শিকার কাহিনী অনুবাদ করে বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়েছেন।
বইয়ের পাশাপাশি যে জিনিষটা টানত, সেটা হল, চিঠিগুলো, কতবার ভেবেছি, চিঠি লেখব, যদি ছাপা হ্য়, কিন্তু আসলে কখন ও লেখা হয়ে উঠেনি। তবে একটা চিঠির কথা মনে আছে, তখন মনে হয় রানা এর ৩২০ এর দিকের বই বের হচ্ছে, একজন চিঠিতে লিখলেন, “শুনলাম, সেবাতে নাকি এখন মাসুদ রানা কাজীদা লিখেন না, লিখে সেবার দারোয়ান”। কথাটা যে সত্যি, তাতে কোন সন্দেহ নাই, তবে, সম্ভবত তার খুব গায়ে লেগেছিল, ফলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “সেবাকে এতদুর চালিয়ে আনার জন্যে সেবার দারোয়ানের অবদান কোন অংশে কারো চেয়ে কম নয়”। চোরের মায়ের বড় গলার মতন শুনালেও কথাটা কিন্তু ২ দিক থেকেই সত্যি। আমার মত যারা একনিষ্ঠ ভুদাইচরিত পাঠক, তারা ভুয়া বই পড়ে বিরক্ত হচ্ছেন, কিন্তু আমাদের কাজীদার ও বোঝা উচিত, গত ৪৩ বছর ধরে মাসুদ রানা ২৯ বছ বয়সে আটকে আছে, এবার বেচারা এক্সিডেন্ট বা হার্ট এট্যাক বা কবির চৌধুরির গুলি খেয়ে মরার হয়ে গেছে।
No comments:
Post a Comment