Tuesday, October 20, 2009

শিবিরের কুকর্মনামা

গত কয়েকদিন ধরে সচল বেশ গরম, আর তার জন্যে আমি কাউকে দোষ ও দেই না। তাই অপেক্ষা করলাম দুইদিন এ লেখাটা দেওয়ার জন্যে। আমি এখন পর্যন্ত শিবিরের নামে কোন ভালো কথা শুনিনি, আর কেউ যদি বলতেও আসেন, তাকে হয়ত খুব খারাপ ভাষায় আক্রমন করব, কিন্তু এমন হল কিভাবে, আমার বয়স ৩০ বছর, কাজেই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ আমি নিজে দেখিনি, বাবা চাচার কাছে গল্প শুনেছি, আমাদের পরিবারের কেউ শহীদ হননি মুক্তিযুদ্ধে, কিন্তু তারপরেও কেন আমি শিবির নামে এই মগজ ধোলাইকৃত ফ্যানাটিক দলের নাম শুনলে ঘৃনায় নাক কুঁচকাই, কেন জান হাতে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ি এদের বিরুদ্ধে, আমাকে তো কেউ আঘাত করে নি বা তাদের দলে ভেড়ানোর ও চেষ্টা করেনি। আমাদের প্রায় সকল কথাই একপেশে ধরনের হয়, কিন্তু আমি আমার কথা বলব, ভুল কিছু বললে আপনারা তো আছেনই শুধরিয়ে দেবার জন্যে।
[আমার লেখা এবং ভাষার ব্যবহারে সংবেদনশীলতার অভাব থাকলে আপনারা নিজগুনে ক্ষমা করে দেবার চেষ্টা করবেন, আমি চেষ্টা করব আমার লাগাম টেনে রাখার, কতটুকু পারব, ঠিক জানি না]

১।উইলো ভাই
আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়ি, প্রতি সন্ধায় পরতে বসা বাধ্যতামূলক, যদি না কারেন্ট চলে যায়। তখন রাজশাহীতে থাকতাম। সপ্তাহে ২-১ দিনতো যাবেই কারেন্ট আর নেমে আসবে ফাঁকিবাজীর সুযোগ, এভাবে চলে যাচ্ছিল সুখের দিন, হঠাৎ দেখি একদিন এক লম্বা চওড়া খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা যুবক এসে হাজির, তার সকল কথাই কেমন যেন অসাধারণ লাগে, কিছুক্ষনের মাঝেই জানতে পারলাম ইনার নাম উইলো ভাই, সদ্য পাস করে বের হয়েছেন, পেশায় প্রকৌশলী, তিনি নিজে কিছু করবেন, নিজেই নিজের বস হবেন, তার নানা রকমের প্রজেক্টের মাঝে চার্জার লাইট অন্যতম, ২০” টিউবলাইটের বাল্ব দিয়ে উনার নিজের বানানো চার্জ লাইট লাগিয়ে দিয়ে গেলেন বাসায়। আমার সে কী উত্তেজনা, সেই সাথে মনো কিছুটা খারাপ হল যে, কারেন্ট তো আর যাবে না। কিন্তু তার পরেও চার্জারবাতি জ্বলবে, এই উত্তেজনায় অস্থির, কখন কারেন্ট যাবে! তার পরের বছরের ঘটনা, শুনলাম, উইলো ভাই নাকি হাসপাতালে, ছোট বলে কেউ আমাকে আর কিছু বলতে চায় না। কিন্তু আমার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে উদ্ধার করলাম, উনি নাকি ছাত্র মৈত্রী করতেন, একরাতে বাসায় ফেরার সময় শিবিরের কিছু লোক তাকে একা পেইয়ে তাকে আঘাত করে, এই অসভ্য ফ্যানাটিকের তাকে অনেক মারে, তারপরেও যখন আর পেট ভরে না, তখন তার ডান হাত ফেড়ে ফেলে কনুই পর্যন্ত, তারপর তাকে বলে, যা এখন দেশের উন্নতি কর গিয়া পারলে। উনি হাসপাতালে ছিলেন মাসখানেক, তার ডান হাত দুইভাগ করে ফেলায় তা অপারেশন করেও কিছু করা যায়নি। রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকতেই পারে, তার জন্যে একজনকে সারাজীবনের মত বিকল করে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের কী উন্নতি সাধন হল, এটা আমার ছোট মাথার ছোট বুদ্ধিতে কোনভাবেই ঢুকল না। কাজেই আমার রাজনৈতিক চেতনা হবার আগেই আমি বুঝলাম, শিবির আর যাই হোক ভালো কিছু অবশ্যই না।

২। ডঃ রতন
আমার বয়স তখন ১০ বছর, আমি গভঃ ল্যাবে পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ি, আমাদের মিড টার্ম পরীক্ষা চলছে, আমি পরীক্ষা দিয়ে বের হই, আপনারা যারা রাজশাহী গেছেন, তারা জানেন যে, লক্ষিপুর মোড়ে স্কুলটা, আর তখন থাকি মেডিকেল ক্যাম্পাসে। বাসায় যাবো, কিন্তু কোন রিকশাওয়ালাই যাবে না। ৩য় জন বল্ল, ঐখানে তো অনেক গন্ডগোল হয়েছে, ঐদিকে যাওয়া যাবে না। শুনেই আমার অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে উঠে দুরুদুরু। কেউ যখন যাবে না, তখন আর উপায় কী? হাঁটা শুরু করি আমরা দুই ভাই। আমার বাবার চেম্বার ও পথেই পড়ে, কাজেই চেম্বারের সামনে এসে চেম্বারের পিওনকে জিজ্ঞেস করি, কী ব্যাপার? এর মাঝে দেখি গেট আর গ্যারাজের সামনে টুকরা টুকরা কাঁচ পরে আছে। সে মুখ কাচুমাচু করে বলে, আজকে তো মহা বিপদে পরেছিল স্যার। আমি কিছু বলার আগেই আমার বড় ভাই জিজ্ঞেস করে, মানে? উত্তরে সে যা বলল তা হল এ রকম –

আমার বাবা, সাথে মেডিকেলের আরো কয়েকজন শিক্ষক হলে গিয়েছিলেন ছাত্রদের মাথা ঠান্ডা করে হল ত্যাগ করার ব্যাপারে আলোচনা করে নিস্পত্তি করতে, এক পর্যায়ে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠে, কোন ফলাফল না পাওয়ায় তারা বের হয়ে আসেন, ফিরতি পথে শিবিরের লোকজন আমার বাবার গাড়ীতে আঘাত হানে, ২ টা জর্দার ডিব্বায় আগুন ধরিয়ে ছুড়ে মারে, কিন্তু আমার মত মামদোবাজের বাবা বলেই টান দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন তিনি, ডিব্বা দুটো মাটিতে পড়ে ফাঁটে বলে কেউ আহত হন নি, কিন্তু এই ফাঁকে তারা আবার আঘাত চালায়, হকিস্টিক দিয়ে, গাড়ির পেছনের কাঁচ ভেঙ্গে বোমা গাড়ীর ভেতরে ঢুকাতে পারলে না সবাইকে এক ডিব্বায় মারা যাবে!!

আমার বাবা কোনমতে সবাইকে নিয়ে জান হাতে নিয়ে পালিয়ে আসেন। তারপরে বসে রুদ্ধদ্বার বৈঠক, সে সময়ে গন্ডগোলের সুত্রপাত ছিল ছাত্র মৈত্রী আর শিবিরের মাঝে হল ভাগাভাগি আর অস্ত্র জমা রাখা নিয়ে। যাক, আমরা ২ ভাই হাটতে থাকি বাসা অভিমুখে, পথে একটু পর পর পুলিশের ব্যারিকেড, বাচ্চা কাচ্চা বলে আর গায়ে স্কুলের পোশাক থাকায় কেউ আটকায় না আমাদের। বাসায় ফিরে আসি। আমি তখন ছোট মানুষ, কাজেই গাড়ীর দুঃখে চরম দুঃখিত, এদিকে আমার বাপের জানের উপর যে হামলা হল, তা আমি বুঝতেই যেন পারছিনা। দুপুরে বাবা মা বাসায় ফিরলেন, বাবার চেহারা দেখে আমি ভয়ে কাছে যাইনি দুইদিন। ভয়ে ভয়ে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কী?
আম্মা বললেন, ফিরে এসে বাবা মিটিঙে যায় ঠিকই, কিন্তু সেখানে বেশিক্ষন থাকতে পারেন নি, কারন তার ডাক পড়ে ইমার্জেন্সিতে, তারপর শুরু হয় জমে মানুষে লড়াই একজন ডাক্তারকে নিয়ে। সেই হতভাগা ডাক্তারের নাম রতন। কী তার দোষ? সে মৈত্রী করত, আর এমন দিনে তাকে তারা একা পেয়েছে, আর বাগে পেয়ে আক্রমন করেছে। তাকে ক্যাম্পাসের বড় রাস্তার উপর আক্রমন করে শিবিরের কিছু নরঘাতক, তারপর তার সকল গিরা ধরে ধরে কাটতে থাকে তারা দা দিয়ে। তার হাত কাটা হয় কব্জিতে, কনুইয়ে, স্কন্ধে। দুই হাত কাটে তারা, তারপর শুরু করে পা, একজন জীবিত মানুষকে পশুর মত করে জবাই করে মারা এক জিনিষ, আর অত্যাচারের উদ্দেশ্য নিয়ে হাত পা কাটা আরেক জিনিষ। কাজেই পা কাটে এই নরপিশাচের প্রতিটি গিরা ধরে, অর্থাৎ গোড়ালী, হাটু, কোমর, সব আলাদা করে ফেলে। তারপরে তারা অপেক্ষা করতে থাকে, কতক্ষন তার দেহ নড়াচড়া করে, তা দেখার জন্যে। এক পর্যায়ে তার রক্তক্ষরনের কারনে মস্তিস্কে রক্তসরবরাহ কমে যায় বলে, তিনি জ্ঞান হারান। তারপর এই নরপিশাচেরা চলে যায় রাস্তার উপরে ডাঃ রতনকে ফেলে। এরপরে তাকে হাস্পাতালে নিয়ে আসা হয়, তার বাঁচার প্রশ্নই আসে না, তারপরেও যুদ্ধ চলতে থাকে, কিন্তু কিছুই করার ছিলনা কারো। ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত দেওয়া হতে থাকে, কিন্তু ততক্ষনে তার মস্তিস্কের কোষগুলো এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে যে কোন ভাবেই আর তাকে ফেরানো সম্ভব ছিলো না।

গ্যাদা কাল থেকে শুধু মানূষের মুখোশে শিবিরের দুর্নামই শুনে গেলাম, কারো কাছে ভালো কিছু শুনিনি এসব নরপিশাচদের নামে, এদের নামে কেউ ভালো কিছু বলতে পারলে জানিয়েন। কাজেই কেউ যদি এদের মানুষ বলে গন্য করতে চান, তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে আমার প্রশ্ন জাগাটা কী খুব অস্বাভাবিক হবে? আর একটি অনুরোধ করে বিদায় নেই, সবসময় সচলে নিজের গল্প ফেঁদে সবার কানের পোকা বের করে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেলেছি, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে মনটা খুবই বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে যে না বলে পারছি না। কেউ যদি অজ্ঞানতার কারনে এমন ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হন, তাদের এই সব ভ্রান্ত ধারনা দূর করার জন্যে আমাদের উচিত একটা তথ্য ভান্ডার বানানো এবং স্বাধীন বাংলায় করা শিবিরের সকল কুকর্মের ইতিহাস সেখানে জমা করে রাখা। কেউ যদি ভুল করেও শিবিরের পক্ষে কিছু বলে ফেলেন, তাকে আমরা সেই সব কুকীর্তির ইতিহাস দেখিয়ে দেব চোখে আঙ্গুল দিয়ে, যাতে ভুল পথে চলার কোন সুযোগ কেউ না পান। ছোট মুখে অনেক বড় বড় কথা বলে ফেললাম, সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, সুস্থ চিন্তা করুন। আজ এখানেই শেষ করছি।

No comments:

Post a Comment