Tuesday, October 20, 2009

সাকিব দ্যা টারমিনেটর

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই একটা করে পোস্টার দেখি আর ভেতরে ভেতরে কুরকুর করতে থাকে, মনে হয়, নিজেও কিছু একটা বানাবো, কিন্তু মাথায় কিছু আসে না, তাই আর বানানো হয় নি এ পর্যন্ত কিছু। কিন্তু আজকের খেলার ফলাফল দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, লেগে পরলাম কাজে। প্রথমে ভেবেছিলাম বাংলায় বানাবো, কিন্তু ফটোশপে বাংলা লিখতে না পারায় সে কাজে ইস্তফা দিয়ে ইংরেজীতেই লেগে পড়লাম। আশা করি আমার মত ভুদাই এর এই অপরিণত প্রচেষ্টা সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

বাংলাদেশের ৮ উইকেটে ৩২০ রান করতে দেখে যত না দাঁত বের হয়েছে, অথবা ৪৯ রানের বিজয় না যত বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তার চেয়েও ব্যাপক মজা পেয়েছি সাকিব এর ৬৪ বলে ১০৪ রান, যা আমার ধারনা বাংলাদেশী কোন ব্যাটসম্যানের করা দ্রুততম শতক, যেখানে ৯ টি চার এবং ৪ টি ছক্কার উপহার দিয়েছেন সাকিব আমাদের এবং জিম্বাবুয়ের বোলারদের চোখ টিপি দেঁতো হাসি. এরকম স্কোর দেখে একটাই কথা মনে এসেছে বার বার, কোপা শামসু, কোপা।

সাকিব দ্যা টারমিনেটর


শিবিরের কুকর্মনামা

গত কয়েকদিন ধরে সচল বেশ গরম, আর তার জন্যে আমি কাউকে দোষ ও দেই না। তাই অপেক্ষা করলাম দুইদিন এ লেখাটা দেওয়ার জন্যে। আমি এখন পর্যন্ত শিবিরের নামে কোন ভালো কথা শুনিনি, আর কেউ যদি বলতেও আসেন, তাকে হয়ত খুব খারাপ ভাষায় আক্রমন করব, কিন্তু এমন হল কিভাবে, আমার বয়স ৩০ বছর, কাজেই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ আমি নিজে দেখিনি, বাবা চাচার কাছে গল্প শুনেছি, আমাদের পরিবারের কেউ শহীদ হননি মুক্তিযুদ্ধে, কিন্তু তারপরেও কেন আমি শিবির নামে এই মগজ ধোলাইকৃত ফ্যানাটিক দলের নাম শুনলে ঘৃনায় নাক কুঁচকাই, কেন জান হাতে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ি এদের বিরুদ্ধে, আমাকে তো কেউ আঘাত করে নি বা তাদের দলে ভেড়ানোর ও চেষ্টা করেনি। আমাদের প্রায় সকল কথাই একপেশে ধরনের হয়, কিন্তু আমি আমার কথা বলব, ভুল কিছু বললে আপনারা তো আছেনই শুধরিয়ে দেবার জন্যে।
[আমার লেখা এবং ভাষার ব্যবহারে সংবেদনশীলতার অভাব থাকলে আপনারা নিজগুনে ক্ষমা করে দেবার চেষ্টা করবেন, আমি চেষ্টা করব আমার লাগাম টেনে রাখার, কতটুকু পারব, ঠিক জানি না]

১।উইলো ভাই
আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়ি, প্রতি সন্ধায় পরতে বসা বাধ্যতামূলক, যদি না কারেন্ট চলে যায়। তখন রাজশাহীতে থাকতাম। সপ্তাহে ২-১ দিনতো যাবেই কারেন্ট আর নেমে আসবে ফাঁকিবাজীর সুযোগ, এভাবে চলে যাচ্ছিল সুখের দিন, হঠাৎ দেখি একদিন এক লম্বা চওড়া খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা যুবক এসে হাজির, তার সকল কথাই কেমন যেন অসাধারণ লাগে, কিছুক্ষনের মাঝেই জানতে পারলাম ইনার নাম উইলো ভাই, সদ্য পাস করে বের হয়েছেন, পেশায় প্রকৌশলী, তিনি নিজে কিছু করবেন, নিজেই নিজের বস হবেন, তার নানা রকমের প্রজেক্টের মাঝে চার্জার লাইট অন্যতম, ২০” টিউবলাইটের বাল্ব দিয়ে উনার নিজের বানানো চার্জ লাইট লাগিয়ে দিয়ে গেলেন বাসায়। আমার সে কী উত্তেজনা, সেই সাথে মনো কিছুটা খারাপ হল যে, কারেন্ট তো আর যাবে না। কিন্তু তার পরেও চার্জারবাতি জ্বলবে, এই উত্তেজনায় অস্থির, কখন কারেন্ট যাবে! তার পরের বছরের ঘটনা, শুনলাম, উইলো ভাই নাকি হাসপাতালে, ছোট বলে কেউ আমাকে আর কিছু বলতে চায় না। কিন্তু আমার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে উদ্ধার করলাম, উনি নাকি ছাত্র মৈত্রী করতেন, একরাতে বাসায় ফেরার সময় শিবিরের কিছু লোক তাকে একা পেইয়ে তাকে আঘাত করে, এই অসভ্য ফ্যানাটিকের তাকে অনেক মারে, তারপরেও যখন আর পেট ভরে না, তখন তার ডান হাত ফেড়ে ফেলে কনুই পর্যন্ত, তারপর তাকে বলে, যা এখন দেশের উন্নতি কর গিয়া পারলে। উনি হাসপাতালে ছিলেন মাসখানেক, তার ডান হাত দুইভাগ করে ফেলায় তা অপারেশন করেও কিছু করা যায়নি। রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকতেই পারে, তার জন্যে একজনকে সারাজীবনের মত বিকল করে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের কী উন্নতি সাধন হল, এটা আমার ছোট মাথার ছোট বুদ্ধিতে কোনভাবেই ঢুকল না। কাজেই আমার রাজনৈতিক চেতনা হবার আগেই আমি বুঝলাম, শিবির আর যাই হোক ভালো কিছু অবশ্যই না।

২। ডঃ রতন
আমার বয়স তখন ১০ বছর, আমি গভঃ ল্যাবে পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ি, আমাদের মিড টার্ম পরীক্ষা চলছে, আমি পরীক্ষা দিয়ে বের হই, আপনারা যারা রাজশাহী গেছেন, তারা জানেন যে, লক্ষিপুর মোড়ে স্কুলটা, আর তখন থাকি মেডিকেল ক্যাম্পাসে। বাসায় যাবো, কিন্তু কোন রিকশাওয়ালাই যাবে না। ৩য় জন বল্ল, ঐখানে তো অনেক গন্ডগোল হয়েছে, ঐদিকে যাওয়া যাবে না। শুনেই আমার অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে উঠে দুরুদুরু। কেউ যখন যাবে না, তখন আর উপায় কী? হাঁটা শুরু করি আমরা দুই ভাই। আমার বাবার চেম্বার ও পথেই পড়ে, কাজেই চেম্বারের সামনে এসে চেম্বারের পিওনকে জিজ্ঞেস করি, কী ব্যাপার? এর মাঝে দেখি গেট আর গ্যারাজের সামনে টুকরা টুকরা কাঁচ পরে আছে। সে মুখ কাচুমাচু করে বলে, আজকে তো মহা বিপদে পরেছিল স্যার। আমি কিছু বলার আগেই আমার বড় ভাই জিজ্ঞেস করে, মানে? উত্তরে সে যা বলল তা হল এ রকম –

আমার বাবা, সাথে মেডিকেলের আরো কয়েকজন শিক্ষক হলে গিয়েছিলেন ছাত্রদের মাথা ঠান্ডা করে হল ত্যাগ করার ব্যাপারে আলোচনা করে নিস্পত্তি করতে, এক পর্যায়ে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠে, কোন ফলাফল না পাওয়ায় তারা বের হয়ে আসেন, ফিরতি পথে শিবিরের লোকজন আমার বাবার গাড়ীতে আঘাত হানে, ২ টা জর্দার ডিব্বায় আগুন ধরিয়ে ছুড়ে মারে, কিন্তু আমার মত মামদোবাজের বাবা বলেই টান দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন তিনি, ডিব্বা দুটো মাটিতে পড়ে ফাঁটে বলে কেউ আহত হন নি, কিন্তু এই ফাঁকে তারা আবার আঘাত চালায়, হকিস্টিক দিয়ে, গাড়ির পেছনের কাঁচ ভেঙ্গে বোমা গাড়ীর ভেতরে ঢুকাতে পারলে না সবাইকে এক ডিব্বায় মারা যাবে!!

আমার বাবা কোনমতে সবাইকে নিয়ে জান হাতে নিয়ে পালিয়ে আসেন। তারপরে বসে রুদ্ধদ্বার বৈঠক, সে সময়ে গন্ডগোলের সুত্রপাত ছিল ছাত্র মৈত্রী আর শিবিরের মাঝে হল ভাগাভাগি আর অস্ত্র জমা রাখা নিয়ে। যাক, আমরা ২ ভাই হাটতে থাকি বাসা অভিমুখে, পথে একটু পর পর পুলিশের ব্যারিকেড, বাচ্চা কাচ্চা বলে আর গায়ে স্কুলের পোশাক থাকায় কেউ আটকায় না আমাদের। বাসায় ফিরে আসি। আমি তখন ছোট মানুষ, কাজেই গাড়ীর দুঃখে চরম দুঃখিত, এদিকে আমার বাপের জানের উপর যে হামলা হল, তা আমি বুঝতেই যেন পারছিনা। দুপুরে বাবা মা বাসায় ফিরলেন, বাবার চেহারা দেখে আমি ভয়ে কাছে যাইনি দুইদিন। ভয়ে ভয়ে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কী?
আম্মা বললেন, ফিরে এসে বাবা মিটিঙে যায় ঠিকই, কিন্তু সেখানে বেশিক্ষন থাকতে পারেন নি, কারন তার ডাক পড়ে ইমার্জেন্সিতে, তারপর শুরু হয় জমে মানুষে লড়াই একজন ডাক্তারকে নিয়ে। সেই হতভাগা ডাক্তারের নাম রতন। কী তার দোষ? সে মৈত্রী করত, আর এমন দিনে তাকে তারা একা পেয়েছে, আর বাগে পেয়ে আক্রমন করেছে। তাকে ক্যাম্পাসের বড় রাস্তার উপর আক্রমন করে শিবিরের কিছু নরঘাতক, তারপর তার সকল গিরা ধরে ধরে কাটতে থাকে তারা দা দিয়ে। তার হাত কাটা হয় কব্জিতে, কনুইয়ে, স্কন্ধে। দুই হাত কাটে তারা, তারপর শুরু করে পা, একজন জীবিত মানুষকে পশুর মত করে জবাই করে মারা এক জিনিষ, আর অত্যাচারের উদ্দেশ্য নিয়ে হাত পা কাটা আরেক জিনিষ। কাজেই পা কাটে এই নরপিশাচের প্রতিটি গিরা ধরে, অর্থাৎ গোড়ালী, হাটু, কোমর, সব আলাদা করে ফেলে। তারপরে তারা অপেক্ষা করতে থাকে, কতক্ষন তার দেহ নড়াচড়া করে, তা দেখার জন্যে। এক পর্যায়ে তার রক্তক্ষরনের কারনে মস্তিস্কে রক্তসরবরাহ কমে যায় বলে, তিনি জ্ঞান হারান। তারপর এই নরপিশাচেরা চলে যায় রাস্তার উপরে ডাঃ রতনকে ফেলে। এরপরে তাকে হাস্পাতালে নিয়ে আসা হয়, তার বাঁচার প্রশ্নই আসে না, তারপরেও যুদ্ধ চলতে থাকে, কিন্তু কিছুই করার ছিলনা কারো। ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত দেওয়া হতে থাকে, কিন্তু ততক্ষনে তার মস্তিস্কের কোষগুলো এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে যে কোন ভাবেই আর তাকে ফেরানো সম্ভব ছিলো না।

গ্যাদা কাল থেকে শুধু মানূষের মুখোশে শিবিরের দুর্নামই শুনে গেলাম, কারো কাছে ভালো কিছু শুনিনি এসব নরপিশাচদের নামে, এদের নামে কেউ ভালো কিছু বলতে পারলে জানিয়েন। কাজেই কেউ যদি এদের মানুষ বলে গন্য করতে চান, তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে আমার প্রশ্ন জাগাটা কী খুব অস্বাভাবিক হবে? আর একটি অনুরোধ করে বিদায় নেই, সবসময় সচলে নিজের গল্প ফেঁদে সবার কানের পোকা বের করে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেলেছি, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে মনটা খুবই বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে যে না বলে পারছি না। কেউ যদি অজ্ঞানতার কারনে এমন ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হন, তাদের এই সব ভ্রান্ত ধারনা দূর করার জন্যে আমাদের উচিত একটা তথ্য ভান্ডার বানানো এবং স্বাধীন বাংলায় করা শিবিরের সকল কুকর্মের ইতিহাস সেখানে জমা করে রাখা। কেউ যদি ভুল করেও শিবিরের পক্ষে কিছু বলে ফেলেন, তাকে আমরা সেই সব কুকীর্তির ইতিহাস দেখিয়ে দেব চোখে আঙ্গুল দিয়ে, যাতে ভুল পথে চলার কোন সুযোগ কেউ না পান। ছোট মুখে অনেক বড় বড় কথা বলে ফেললাম, সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, সুস্থ চিন্তা করুন। আজ এখানেই শেষ করছি।

আমাদের কুদ্দুস ভাই

"সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন যেন আমি লেখালেখি করি"

নারে ভাই, কবিতা লেখতেছি না, মারতেছিও না। এইটা হইল আমাদের বিখ্যাত লেখক এবং ব্লগার আবদুল কুদ্দুস ওরফে আকু ভাইয়ের মূলমন্ত্র। সকালে তার ঘুম ভাঙ্গে এই মন্ত্র জপতে জপতে। তারপর তিনি জৈবিক কার্য সেরেই ব্লগ খুলে বসেন। বহুত পুরানো ব্লগার তিনি, লেখেনও সেই রকম। হাবিজাবি ব্লগ সাইটে লেখার মত পাতি ব্লগার নন তিনি। হাজার হলেও সিনিয়ার মানুষ তো। তার মত কৃতিমান ব্লগারের কথা জানতে পেরেও বুকের মাঝে কেমোন চিলিক পারা আনন্দের সৃষ্টি হয় যে কি বলব, ঘুমের মাঝেও চিক্কুর পাইরা উঠতে ইচ্ছা করে।

তা উনার নিজেরই ব্লগ সাইট আছে আকুপাকু.কম নামে, সেখানে তিনি ব্লগ লেখতে লেখতে চুল দাড়ি পাকায় ফেললেন প্রায়, তার ব্লগে আবার নাম ধাম নিতে কোন সমস্যা নাই, তিনি খাপ খোলা লেখা লেখতে যেমন পছন্দ করেন, তেমনি পছন্দ করেন অন্যের খাপ খোলা মন্তব্য শুনতে। আর যেহেতু উনার ব্লগে কেউ কারো মাথায় ছড়ি ঘুড়ায় না, এজন্যে যে যার মত ব্লগ লিখে যায়। কিন্তু সুখে থাকলে মানুষকে ভুতে কিলায়, ফলাফল আমাগো আকু ভাইরেও ভুতে ধরল, তিনি নিজের ব্লগের মান নির্ধারনের জন্যে অন্যান্য ব্লগে ঢুঁ দেওয়া শুরু করল। এইভাবে সে একদিন সচলায়তনে এসে হাজির হল।

এইখানে এসে আকু ভাই বুঝল যে, আরে এই খানে তো অনেক কিসিমের লেখা আসে, অনেক সমঝদার লোকও আছে, এইটা না তার আসল ঠিকানা। কাজেই সাথে সাথে নিবন্ধন করে ফেললেন আমাদের আকু ভাই। কিন্তু মর জ্বালা, এখানে তো নিয়ম কানুন অন্যরকম, প্রথমে অতিথি নামে লিখতে হয়, তারপর মডু দাদারা সেটা পড়ে মান বুঝে ছাড় দেন। তিনি তো হেসেই কুল পান না, তার লেখা ঠেকাবে এমন মডারেটর আছে নাকি ত্রিভুবনে! ২ কাপ চা পিরিচে ঢেলে খেয়ে ফেললেন তিনি, তারপর পিরিচটাও চেটে নিয়ে আঙ্গুল মটকিয়ে লেখতে বসলেন।

পারলে আজকেই নামিয়ে দিবেন টেলিশের টেলিফোন বইয়ের সমান লেখা। তরতর করে করে লেখে যেতে লাগলেন তিনি। মোটামোটি পাতা পাঁচেক লেখার পর ভাব্লেন, এত উচ্চ মার্গের লেখা তো মনে হয় না এখানে কেউ লেখে, তাই এখানেই ক্ষ্যান্ত দেওয়া যাক আজকে রকমের মানসিকতা নিয়ে লেখা পুস্টায় দিলেন। বুঝেন অবস্থা, এ কালের সেরা ব্লগার তিনি, আর ধৈর্যের কোন কমতি নাই, তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন আকুপাকু.কম, আর সচলে লেখা দেওয়া তো কোন ব্যাপারই না। ব্লগিং কাকে বলে বুঝিয়ে দেবেন তিনি সবাইকে। সচলকে সমৃদ্ধ করবেন তিনি, এই সংকল্পে বদ্ধপরিকর হলেন আমাদের আকু ভাই।

রাতে লেখা দিয়ে ঘুমাতে গেলেন, সকালে উঠে দেখেন, বাহ, প্রথম পাতায় ঝকঝক করছে তার লেখাটা। তার লেখায় ১২ টা মন্তব্যও পড়েছে, গর্বে তার বুক ফুলে উঠে, আনন্দে আলাজিহ্বা বের হয়ে যায়। পোস্ট খুলে তিনি আঁৎকে উঠেন, একি, ৫ টে ১ তারা দিয়েছে তাকে কে যেন। কার এত বড় সাহস! তার তো মাথা গরম হয়ে যায়, গরম মাথা নিয়েই মন্তব্য পড়তে শুরু করেন। বিশাল মন্তব্য করেছে তার প্রথম মন্তব্যকারী, নানা ভাবে তাকে জ্ঞান দিয়েছে, আর বলেছে বই পড়তে, সে যা লিখেছে, তা নাকি কোন ভাবেই বাংলা নয়। রাগে তিনি কাঁপতে থাকেন, কাঁপা হাতেই জবাব দিতে থাকেন। আরে ব্যাটা বিশিষ্ট লেখক হুমাও তো মায়ের পেটে থেকে পড়েই লেখা শুরু করেছে। সেখানে সে নাহয় আরেকটু পরেই লেখা শুরু করেছে, তাই বলে এত বড় কথা। সে কিনা কত দিনের ব্লগার। আকুপাকুতে তার উপদেশ পাবার জন্যে অন্যেরা হা করে বসে থাকে।

তিনি প্রথম লেখেন ৭ বছর বয়সে, প্রথম লেখা ছিল একটা হাসির গল্প, সেটা পড়ে কেন জানি কেউ বুঝল না, প্রথম এক প্যারা পরেই পড়িমড়ি দৌড়, তবে পাড়ার পাগলা মজনুকে তিনি পড়ে শুনিয়েছিলেন গল্পটা, কিন্তু পাগল মানুষ তো গল্প শুনিয়ে শেষ করতে না করতে রক্তবমি করতে করতে পাগলাটা মারা গেল। কিন্তু তাতে তার লেখা আটকায় থাকে নাই। ১৮ বছর বয়সে তিনি ব্লগিং শুরু করেন। তার ব্যাপারে উড়া কথা শুনা যায়, তিনি নাকি স্কুলে থাকতে রচনা লেখলে স্যারেরা পড়ার মত ধৃষ্টতা দেখাতেন না। খাতা না খুলে ১৫ তে ১২ দিয়ে দিতেন। পাছে যদি আবার আকু ভাই তার বাবা মাকে ডেকে আনেন, তখন তাদের সমানে ঐ রচনা তো পড়তে হবে, আসলে মজনুর কথা কেউ ভুলতে পারে নাই।

যাক, আস্তে আস্তে তার রাগ পড়ে আসে, আসলে এরা বুঝতেই পারে নাই, তিনি কি লিখেছেন, তাই এসব আবোল তাবোল মন্তব্য করেছে। আর তিনি তো "সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কিসের ভয়" এ বিশ্বাসী, ১০-১২ টা খারাপ মন্তব্যে ভয় পাবার প্রশ্নই আসে না, কাজেই মন্তব্য করা বাদ রাখলেন। বরং দ্বিতীয় লেখায় হাত লাগালেন। দেখ ব্যাটারা, এবার আরো সহজ করে লেখব, যেন বুঝতে পারিস। তারপর কাজে চলে গেলেন। নানা কাজের ফাঁকে সচলে আসতে পারেন নি, ফলে দেখতে পেলেন না, তার দ্বিতীয় লেখার করুন পরিণতি।

এবারে মন্তব্য এসেছে আরো বেশি, কিন্তু সমস্যাটা তিনি বুঝতে পারলেন না, তার লেখা কেউ বুঝতে পারছে না কেন? এবারে তো এক্কেবারে সহজ করে লেখলেন, কি মুসিবত। যাক দানে দানে তিন দান, আবার লেখতে বসলেন। এবারেও যদি তার লেখা কেউ বুঝতে না পরে, তাহলে তো ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। এদিকে আকুপাকুর সবাই জেনে গেছে তিনি সচলে লেখা দিয়েছেন। আবারো লেখা দিলেন, এবারে দেখা গেল, তার লেখায় প্রায় কোন মন্তব্যই পড়ে নাই, তবে ভোট পড়েছে প্রায় ১০টা ১ ভোট। রাগে দিশেহারা হয়ে গেলেন আমাদের প্রি্য ব্লগার আকু ভাই। আজকে তোদের একদিন কি আমার একদিন। হঠাৎ করে মাথায় এক বুদ্ধি এল, আসলে এখানে সাড়া পেতে হলে তাকে এদের মত করে লেখতে হবে, কাজেই কয়েকজনের পুরানো ব্লগ ঘাটতে লাগলেন, একটা লেখা খুব পছন্দ হল, সেটা খুব জনপ্রিয় এই ব্লগ সাইটে।

কাজেই তিনি ছদ্মনাম হাকু নিয়ে ঐ লেখাটার আদলে আরো রসিক আরেকখানা লেখা দিলেন। কিন্তু দেখা গেল, এক ভোদাই অতিথি ফাল পাড়তে পাড়তে এসে তাকে খুব গালমন্দ করল, তাছাড়া অন্যান্য যারা ছিলেন, তারাও ভ্রদ্রতার রাশ টেনে ধরে অনেকভাবে তাকে কথা শুনিয়ে দিল, কিভাবে যেন বুঝেও গেল, যে তিনি আকু ভাই। কাজেই তাকে বিদায় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকল না। মহা বিপদ, তিনি বুঝতে পারলেন না, পূর্ণ সচল যারা, তারা নাহয় তাকে উপদেশ দেন, কিন্তু যারা অতিথি, তারা কেন এমন তাফালং করে, তিনি আর তারা তো একই দলে। কি উগ্র ভাবেই না তারা তাকে নিয়ে পরিহাস করে।

কিন্তু ইতিহাসেও এমন কেউ নাই যে তাকে অধ্যবসায়ে হারাইতে পারে, সবাই কিনা কথা কথায় কথায় রবার্ট গ্রসের কথা বলে, আরে ঐ ব্যাটা তো একটা ভন্ড বিশ্বাসঘাতক, নিজের বন্ধুরে ধরায় দিসিল সম্পত্তির লোভে, পরে অনুশোচনায় পইড়া না ব্যাটা যুদ্ধ করতে আসল। তিনি তো শত কেন, হাজার বার দরকার পড়লেও ফিরে আসবেন এই সচলে, এদের দেখিয়ে দিবেন ব্লগ কিভাবে লেখে, ব্লগ কত প্রকার ও কি কি! তাই তিনি গুন গুকরে গান গাইতে গাইতে আবার লেখতে বস্লেন... ... ...

যদি তোর ব্লগ পড়ে কেউ না হাসে
তবে একলা পড় রে ... ... ...
একলা লেখ, একলা পড়
একলা লেখ, একলা পড়রে ... ... ...

Monday, October 19, 2009

ছিদ্রান্বেষী

অনেকদিন কিছু লিখি না, নানান রকমের ঝামেলা এসে মাথায় ভর করেছে একসাথে, প্রতিদিন ভোর ৫টায় উঠে দৌড়াতে হয় দূরে এক হাসপাতাল, ১ ঘন্টার রাস্তা উড়ে যাই যেন ৪৫ মিনিটে, আর আল্লাহ-বিল্লাহ করি, যেন মামু না ধরে। এর মাঝে সবাই অনবরত জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছেন লেখি না কেন। রোজ বাসায় ফেরার পথে ভাবি, আজ গিয়ে কিছু লেখব, কিন্তু বাসায় এসে কোনমতে দিনের প্রথম ভাত গলাধ:করণ করে মেয়ের সাথে কতক্ষণ খুটুর মুটুর করে আবার ঘুম দেই, লেখব কখন? তারমাঝে সচলে বেশ কয়েকদিনে কোমর বেধেই যেন ঝগড়া করলাম কয়েকজনের সাথে। একজন তো আবার আর এক লেখা পড়েই আমার চরিত্র বিশ্লেষণ করে ফেলল। যাক, প্রথম সুযোগেই আবার অপরের বদনাম শুরু করেছি। মানুষের ছিদ্র খুঁজতে কেন যেন ব্যাপক মজা লাগে। কোথাও কাউকে পেলেই হেঁড়ে গলায় বদনাম শুরু করে দেই। তাই ঠিক করলাম, বেহুদা মানুষের ছিদ্র অন্বেষণ না করে নিজের ছিদ্রই খুঁজি না কেন?

আমি নিজেকে খুব রসিক মনে করি, সবাইকে নানাভাবে যন্ত্রণা দিতে পারলে আমার বিটকেল দাঁত থেকে আলাজিহ্বা পর্যন্ত সবই বের হয়ে যায়, কিন্তু দেখা যায়, অন্যকেউ সেই রসিকতা করলে প্রায় সময়ই সেটা গ্রহণ করতে পারি না, গরম কড়াইয়ে পানি পড়লে যেমন ছ্যাঁত করে লাফিয়ে উঠে, আমিও যেন সেভাবেই সমালোচকের ঘাড়ে চড়ে বসি। তারপর আবার বনমানুষের মত বুকে বাড়ি দিয়ে বলি, আমার চামড়া অনেক মোটা, কারো কথায় আমার কিছু আসে যায় না!!

কাজের সুবিধার্থে ধুমধাম মিথ্যা কথা বলি, এমনকি চোখের পাতাও পড়ে না, এমন হয়েছে যে, যার সাথে চাপা মারছি, তাকে নিয়েই হয়ত চাপা মারছি, এক পর্যায়ে সেও দ্বিধান্বিত হয়ে যায়, আসলেও সত্যি নাতো? অবশ্য বেশীর ভাগ সময় তা মজা করার জন্যই করে থাকি। তবে মজা বেশী হয় যখন আমার মারা চাপা, চামের উপর বামে দিয়া লেগে যায়। একটা উদাহরণ দেই, তাহলে বুঝবেন, আমার শালীর এক দোস্তের সাথে অন্তর্জালে বকবক করছি, আজাইরা প্যাচাল পারতেছি, কথা বলতে ইচ্ছা করতেছে না, নানা ভাবে ইংগিত দেবার পরও যায় না। হঠাৎ মাথায় দুষ্টামি ভর করল, বললাম, "শুনলাম, তোমার বয়ফ্রেন্ডের বলে মাথায় সমস্যা" যেহেতু আমি জানি, ঐ মেয়ের বয়ফ্রেন্ড নেই, কাজেই আমি জানি সে হেসে উড়িয়ে দিবে, সে তো ঐদিকে মহা গম্ভীর, আর কথা বলে না, খালি একই প্রশ্ন, কে বলল আপনাকে? অমুকে বলেছে? তমুকে বলেছে? তারপর আমার শালীকে অন্তর্জালে পেতেই তাকে আক্রমন, একটু পরে আমার শালী ফোন করেছে, আপনে কি বলেছেন "____" কে, আমাকে দোষ দিচ্ছে, যেন আমি বলে দিয়েছি, ঢাকা থেকে ফোন করতেছে একটু পরপর। আমি তো হাসতে হাসতে শেষ।

নোটিস দিয়ে বাসায় হাজির হয়ে ভাত খেয়ে বের হওয়া মনে হয় আমার মহৎ গুনাবলীর মধ্যে আরেকটা, আর এই গুনের ফলাফল ভোগ করেছে আমাদের মৃত্তিকা সহ আরো অনেকেই। কেউ রাঁধতে না পারলেও মাফ নাই, অফিস থেকে গাড়ি করে তুলে নিয়ে খাবারের দোকানে গিয়ে হাজির। তারপর জিজ্ঞেস করব, কি খাবা? তারপর বিল দেবার সময়, ইয়ে মানে, আমার কাছে ক্যাশ নাই, বিলটা একটু দিতে পারবা? এমন শিকারে পরিণত হয়েছে মনে হয় সবচেয়ে বেশী অনিকেতদা।

রাঁধতে পারি না কিছুই, অথচ খাবার সময়, নাক সিঁটকিয়ে বলে ফেলব নির্লিপ্তভাবে, "এহ হে, খাবারে লবণ বেশি হয়েছে বা কম হয়েছে" অথবা, "ধুর এইটা কি কোন রান্নার জাত হল, মুখেই দিতে পারছি না", অথচ নিজে রান্না করলে ধুরুম ধারুম প্লেটে উঠিয়ে দিব, আর মুখ ফুটেও বলব না, আমি রান্না করেছি, পাছে যদি কেউ না খায়। হাবিজাবি রান্নার প্রায়ই অপচেষ্টা করতে থাকি, আর এই যন্ত্রনার শিকার হয় আমার স্ত্রী। বেচারী আগে মুখে দিত, আমার চিকেন মারসালা (মারসালা ওয়াইন দিয়ে জ্বাল দিতে হয়, ভাজি করার পর) খাবার পর থেকে পথ ভুল করেও আর এসব মুখে দেয় না। আমি যেসব জিনিষ খাই, সেগুলাই যেন দুনিয়ার সেরা খাবার, যেটা খাইনা, সেটা আমার সামনে কেউ খেলে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপে ব্যাপকভাবে নাজেহাল হতে হয়। যেমন, সেদিন কাকড়ার শেদ্ধ ঠ্যাঙ নিয়ে বসলাম, প্লায়ার দিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে খাচ্ছি, আর আসে পাশে বসা সবাই তটস্থ হয়ে আছে, কখন সেই পানি গিয়ে গায়ে লাগবে, অথচ আমার কোন বিকার নাই।

রান্না নিয়ে আরেকটা ঘটনা বলি, যেটা আমি খাইনা, কেউ আমাকে জোর করে খাওয়াতে পারবে না, আমার স্ত্রী আর শাশুড়ি এপর্যন্ত আমাকে খাইয়ে শান্তি পেল না, কারন উনারা যেসব পছন্দ করেন, আমি সেসব খাইনা। আমার স্ত্রী পটল আর সাজনা খায় না, এই নিয়ে কত যে কথা শুনালাম, ২-৩ বার ভুং ভাং দিয়ে খাইয়েও দিয়েছি পটল। যাক, এদিকে আমার স্ত্রী গরুর জিহ্বা খায় না, খাওয়া তো দুরের কথা, দেখলেই তার বমি পায়। তার মনে হয়, একটা গরু দাড়িয়ে হাম্বা হাম্বা করতে করতে জিহ্বা বের করেছে, আর আমি লাফিয়ে গিয়ে কামড়ে ধরেছি গরুর জিহ্বা, দুর্ভাগ্যবশত গত ৪ বছরে আমি সন্ধান পাইনি জিহ্বার, হঠাৎ সেদিন শপ-রাইট নামের এক বিপনীবিতানে গিয়ে দেখি, বিশাল বিশাল গরুর জিহ্বা। স্ত্রী সাথে যায়নি, এই সুযোগ, চুপচাপ কিনে এনে সোজা ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তারপর নানা কসরত করে রান্না করেছি। আমি খুব ভালো ভাবেই জানি, আমার স্ত্রী আমার অপছন্দের কিছু রান্না করতে গেলে বাসা মাথায় তুলে ফেলতাম। এজন্যে আমি আমার স্ত্রীর ধৈর্যের কাছে চিরঋণী। সেই সুযোগে আমি আবার ইদানিং তাকে সাধাসাধিও করি জিহ্বা খাবার জন্যে।

আমাকে আপন কেউ যদি কিছু বলেন, তখনই সাথে সাথে ঘাড়টা ত্যাড়া হয়ে যায়, যত ভালো কথাই বলুক না কেন! যেই বাইরের কেউ সে কথাটা বলে, তখন যেন এই শূন্য নারিকেলের খোল ভেঙ্গে শব্দ মাথায় ঢোকে, আমার প্রিয়জনেরা আমাকে হজম করেন কিভাবে, সৃষ্টিকর্তাই মনে হয় জানেন। আর তর্ক করার কথাতো বল্লামই না। কারনে অকারনে তর্ক করে আগে ব্যাপক মজা পেতাম, এখন আর পাই না। কিন্তু এসব ছিদ্রতো অতিশয় ছোট, সবচেয়ে বড় ছিদ্র হল আমার রাগ। কাথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই রাগ উঠে যায় আমার মাঝে মাঝে, বা বেমক্কা কেউ যদি ধাক্কা দেয়, আর আমার চশমা যদি বেসামাল হয় তাতে, তাহলে কথাই নেই। কদিন আগে বাসা পাল্টালাম, বাক্স নামাচ্ছি একা একা, সিড়িতে বাক্সের গুতা লেগে চশমা পড়ে গেল, এমন রাগ উঠল যে কি বলব। নিজের সাথেই ব্যাপক খিস্তি খেউড় শুরু করলাম, পাশের বাসার মহিলা দৌড়ে চলে এসেছে, কাকে খিস্তি দিচ্ছি দেখার জন্যে। অনেক সময় খিস্তি হয়ত দেই না, কিন্তু হঠাৎ করেই মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে যায়, তখন সামনে যে থাকে, ২-১ টা বিশ্রী ধমক অন্তত জুটে।

গাড়ি চালাতে গেলে রাগ খুব একটা উঠে না, চাপ দিলে বেশির ভাগ সময় পাল্টা চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকি বা থাকার চেষ্টা করি। যারা আমার মামদোবাজি সিরিজ পড়েছেন তারা জানেন ৫নং এর ঘটনা। এরপর থেকে চাপ খেয়ে চাপ দিতে পাগল হয়ে যাই না। কিন্তু তারপরেও রাগের বহি:প্রকাশ হিসাবে গাড়ি শিকার হয়েছে বহুবার। দেশ থেকে "সুইডেন ফিরোজ" আসল ডেলাওয়ারে, ব্যাটা একটা আস্ত গাড়ল। তার গল্প নাহয় আলাদা করে লেখব। যারা বুয়েটের ছাত্র তারা মনে হয় আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবেন আমার ঐ লেখার দেবার পর। যাক, তাতে কোন সমস্যা নাই। তিনি বু্যেটে বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান। ইনার স্ত্রীকে আর ২ মেয়েকে নিয়ে গেলাম আমাদের শহরের মলে, তারা জানেন যে, রাতে আমাদের নিউ ইয়র্ক যেতে হবে, আমি উনাদের কতক্ষন ঘুরার পরে বললাম, আমি গাড়ি নিয়ে J C PENNY এর সামনে দাড়াচ্ছি, আপনারা ১৫ মিনিটের মাঝে চলে আসেন। আমি বাইরে গিয়ে এসে দাড়িয়ে আছি, সিকিউরিটি এসে আমাকে কয়েকবার তাড়িয়ে দিল, কিন্তু এই ভদ্রমহিলার আর কোন খবর নেই, আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করে তাড়া দিচ্ছি, আর সে বলে, এইতো ৫ মিনিট। এভাবে ৪৫ মিনিট যখন পার হয়েছে, তারা এসে হাজির গেটে। এরপর তাদের গাড়িতে উঠিয়েই ধুন্দুমার টান, পুরা ঢাকাই ফ্যাশানে টান। তিনি নানা রকমের দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করলেন, আমাকে কয়েকবার উপদেশ দেবারও চেষ্টা করলেন, এদিকে আমার স্ত্রী চুপ, কারন সে তো জানে, ঘটনা, খারাপ। আমি মলের পার্কিং লট থেকে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে ২ গাড়ির মাঝে খান দিয়ে সাই করে টান দিয়ে গিয়ে আই-৯৫ এ উঠলাম, তারা পোঁ পোঁ করে হর্ণ বাজালো, তাতে কি আমার রাগ পড়ে? আই- ৯৫ এ উঠেই একটানে ৯০ মাইল, তারপর এর ওর ফাঁক দিয়ে সাই সাই করে ওভারটেক করতে থাকলাম। বাসায় এসে যখন নেমেছি, চারদিকে টায়ার পোঁড়া গন্ধ, আর পেছনে বসে মা-মেয়ে ৩ জনের গা হাত-পা ঘেমে গিয়েছে। এরপর তারা আর আমার গাড়িতে উঠে নাই।

চলবে?

সব কটা জানালা ফেলে দাও না

কালকে খোমাখাতায় উবুন্টু নিয়া মজা করতে গিয়ে মনে হইল, যাই এইটা নিয়া আরেকটু মজা করি গিয়া। ভিন্ন সময়ে ভিন্ন জানালার আগমনের সাথে সাথে আমার মানসিক অবস্থা নিয়া লেখা শুরু করব বলেই ঠিক করলাম। আমার দেখা প্রথম জানালা ছিল ৩.১১, সাল ১৯৯৫। সম্ভবত খুদেনরম কোম্পানির অন্যতম বিশ্বস্ত কার্যকরি অনুক্রম (অপারেটিং সিস্টেম, কারো মাথায় ভালো বাংলা আসলে একটু সাহায্য করতে পারেন)। যাক, ডসে কম্পু চালু কইরা উইন লিখে জানালা দিয়ে উঁকি মারতে ব্যাপক মজা পাইতাম। আর তারচেয়েও মজা ছিল ডসের খেলাগুলা, পারস্যের যুবরাজ, প্যারানয়েড এবং অন্যান্য। তখন কিভাবে কম্পু চালায় তাই জানতাম না, কাজেই চালু করে ফাইল ঘাটতাম আর ই-এক্স-ই, কম, ব্যাট ওয়ালা ফাইল পাইলেই চালানোর চেষ্টা করতাম। এক পর্যায়ে শিখলাম, কম্পুর অনেক ফাইল দরকারি না, কাজেই মুছা শুরু করলাম, তখনও জানতাম না যে, কমান্ড.কম ছাড়া কম্পু চলে না। মুছতে চায় না, আমিও কি কম গাড়ল, তখন নরটন কমান্ডার ব্যবহার করতাম, গায়ের জোরে মুছে দিলাম, আর তো চলে না।

এভাবে চলতে থাকে জানাল দিয়ে উকিঝুকি, হঠাৎ করেই শুনি, নতুন মাল আসতেছে, নাম জানালা ৯৫, এটা নাকি দেখা মাত্র মাথা বন বন করে ঘুরবে। আমার প্রথম কম্পু কিনেছিলাম আমার বড় ভাইয়ের বন্ধুর মামার দোকান থেকে, কিছু হলেই গিয়ে তার ঘাড়ে চড়ে বসতাম, মামা এটা দেন, সেটা দেন, প্রথমবার যখন ইন্দুর দৌড়ানি বন্ধ করল, নিয়ে দৌড় মামার কাছে, তিনি হেসে দেখিয়ে দিলেন, কিভাবে খুলে পরিষ্কার করতে হয়, বিরক্ত করেছি অনেক, তবে আমার হাতে সময় থাকলেই গিয়ে উনার জোড়াতালির ঘরে গিয়ে বসে থাকতাম, কিভাবে কার সাথে কোনটা লাগায়, কোনটার কি নাম, কি কাজ, হেন হেন কতকিছু। কাজেই জানালা ৯৫ যখন এসে হাজির হল, আমার না পাওয়ার প্রশ্নই আসে না, ২ প্যাকেট ফ্লপি কিনে বান্দা হাজির, বললাম, মামা আমি কপি করে নিব, আপনার কষ্ট করতে হবে না, কাজেই ১৫ ফ্লপিতে জানালা কপি করে নিয়ে পড়িমড়ি দৌড়।

বাসায় গিয়ে সে কি উত্তেজনা, ভাত আর নামে না গলা দিয়ে, কতক্ষনে জানালা লাগাবো আমার বাক্সে। যাক, প্রায় ১ঘন্টা ঘুটুর মুটুর করে অনেক ঢাক গুড়গুড় করে বাক্সে জানালা লাগাইলাম, তারপরে আসল, "জানালা ৯৫ এখন এই কম্পুতে চলবে প্রথমবারের মত"। দেখে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল আমার শিড়দারা দিয়ে। তারপরেই শুরু হল নানা রকমের যন্ত্রনা, শব্দ আসে না, মনিটর কেমন করে, কত পদের ঝাকাঝাকি যে দেখলাম। তারপরে বুঝলাম, আচ্ছা অটোএক্সেক.ব্যাট এ কিছু লিখে রাখলে তা এমনিতেই শুরুতে চলতে থাকে। ড্রাইভার এর জন্যে উইন.আই-এন-আই এ কিভাবে কি লিখতে হয়। প্রতিদিনই নতুন কিছু শিখছি। আর সেই সাথে চলছে নগ্ন মহিলাদের ছবি সংগ্রহের যুদ্ধ, খালি খবর পেলেই হল, অমুকের কাছে ১৫টা ছবি আছে, ফ্লপির পোটলা নিয়ে দৌড়। আর এক ফ্লপিতে না আটলে পিকে-জিপ দিয়ে কমান্ড লিখে ছোট ভাগে ভাগ করে ফাইল আনার পন্থাও তখন শিখে গেছি। আমার এই সব কুকর্মের সাথী ছিল আমার দোস্ত ইমরান, সে বেচারাও এখন মারিকায় থাকে, বাফালোতে। একদিন খবর পেলাম, শরিফের কাছে নাকি এত ছবি আছে, যে দেখে শেষ করা সম্ভব না, বিকালে স্যারের কাছে পড়তে যাবার কথা, কিন্তু তা কি করে হয়, আমরা দুজনে ছুটলাম, শরিফের বাসায়, আমার ২০টা আর ইমরানের ২০টা ফ্লপি নিয়ে, ৩৩টা লাগল মনে হয়, তারপর সেই ছবি নিয়ে এসে সব বন্ধুকে ছবি দেখার দাওয়াত দেবার মধুর দিনগুলোর কথা মনে পড়লে দাত বিটকেল হাসি বের হয়ে যায়।

এভাবে কেটে যেতে থাকে ১৯৯৬, আমি তো প্রবল উৎসাহে সবাইকে দেখাই, আমার কম্পুতে জানালা ৯৫ আছে, ততদিনে হার্ডডিস্ক খুলে দৌড়ানোর সাহস অর্জন করেছি, ফ্লপি আর সহ্য হয় না, যখন তখন বাতিল হয়ে যায়। আমার এই অতি উৎসাহ দেখে আমার ফুফাতো ভাই বললেন, আরে মিয়া, এইসব দেখে লাফাইও না, এগুলা সব বিল কাগুর চুরির ফসল। এখানে থেকে সেখান থেকে চুরি করে জোড়াতালির ফসল এই জানালা ৭। আর কোন খেলা চলতে চলতে হঠাৎ আটকে যেত, মেজাজটাও খারাপ হত তখন সেই রকম। ততদিনে 'মরটাল কমব্যাট - ২' এর ভুতে ধরেছে আমাকে আর আমার আরেক ফুফাতো ভাইকে। সারাদিনই মার মার কাট কাট চলছে। এমন পিটানো পিটাইলাম যে কি বলব, কিন্তু আমার ভাইটাও কম যায় না, আমাকে পেদিয়ে ছাদে তোলার অবস্থা করছে, আর আমাদের এইন পিটাপিটির ফলাফল সহ্য করে যাচ্ছিল কিবোর্ড খানা, এক পর্যায়ে সে বেঁকে বসল। কিন্তু তখন কিবোর্ডের অনেক দাম, আম্মাকে বললেই টাকা না দিয়ে পেদিয়ে আমাদের দুজনকেই চাঙ্গে উঠাবেন, কাজেই দুজনেই মাথা ঘামাতে লাগলাম, কি বলে আম্মার মন নরম করা যায়। একবার ভাবলাম, বলব, ভাইরাস ধরে কিবোর্ড নষ্ট হয়ে গেছে, পরে ভাবলাম, আম্মা যদি কাউকে জিজ্ঞেস করে, তবে পিটিয়ে ছাদে না তুলে পিঠের চামড়া তুলে মরিচ দেবার সম্ভাবনাই বেশি। এর মাঝে বাজারে আসল জানালা ৯৭।

এবার হার্ডডিস্ক নিয়ে হাজির, "মামা, ৯৭ দেন" ব্যাপক জরুরি। মামা আমাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে পারলেই মনে হয় বেঁচে যান, তাই বিনাবাক্য ব্যয়ে আমাকে দেখিয়ে দিলেন, অমুক কম্পুতে ৯৭ আছে, কপি করে নাও। আমিও পটাপট কপি করে আবার দে-দৌড়। ৯৭ লাগিয়ে আম্মাকে গিয়ে বললাম, "আসলে কম্পুতে নতুন 'নরমতার' লাগানোর পর থেকে কিবোর্ড আর কাজ করছে না", উনি বললেন, "ব্যাটা নচ্ছাড়, নতুন জিনিষ ভরেছিস কেন?" আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম, আসলে আগামী ২ মাস পর থেকে জানালা ৯৫ আর কাজ করবে না। উনি বললেন, "হুমম", যা কিবোর্ড কিনে নিয়ে আয়। যাক, নতুন কিবোর্ড কিনে এনে পণ করি যে, আর খেলবো না, কিসের কি? এক বন্ধুর কাছে খবর পেলাম, মরটাল কমব্যাট - ৩ এসেছে, সেখানে নাকি মারলে ছাদ ভেঙ্গে উপর তালায় উঠে যায়। সেই সাথে আরো কতকিছু। ততদিনে গেম খেলার পাশাপাশি খুদেনরমের অফিস, কোরেল ড্র, লোটাস নিয়ে খোচাখুচি চলছে ব্যাপক হারে। এর মাঝে খবর পেলাম, আমার আরেক দোস্ত সালমান (নটরডেমের সবাই চেনার কথা) নাকি কি এক ফাইল বানিয়েছে, যেটা চালালেই গিয়ে কম্পু চালু হবার স্থানে গিয়ে আস্তানা গাড়ে, গিয়ে আরেকজনের কাছ থেকে সেই জিনিষও আমদানী করলাম। হাতে ফ্লপি নিয়ে তৈরি হয়ে চালু করলাম দোস্তের সেই জিনিষ, কম্পু নিজেই বন্ধ হয়ে পুনরায় চালু হল, কিন্তু, এক্কেবারে "খাস কাম" শুরু হয়ে গেল প্রথমেই, দেখে হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি চলে আসলো।

১৯৯৮ এ এসে আমি তো ৯৭ নিয়ে বেশ কাহিল, আগারে বাগারে খালি আটকে যায়, খুদে নরমের অফিসের সাথে কি যেন একটা গ্যান্জাম ছিল, সেটা বন্ধ করলেই কম্পু আটকে বসে থাকত হা করে। মোটামুটি এ সময়ে এসে আমি এদের উপর মহা বিরক্ত। আর তখন বাপ-মায়ের কিছু কাজ করে দিতাম নিয়মিত, আর তাদের সামনে গালিও দিতে পারতাম না বিল কাগুকে শান্তি মত। আর কম্পুও বেশ পুরান হয়ে গেছে, আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল 486DX2 দিয়ে। ততদিনে পেন্টিয়াম এসে পড়েছে বাজারে, কিন্তু, আম্মাকে বুঝাতে পারছি না যে কম্পু পাল্টানো দরকার। যাক, শেষমেষ আমার বড়ভাই বুঝাতে পারলেন কম্পু পাল্টানো দরকার, তারপরে কিনলাম, পি-২ ৩৫০। আমার ২য় কম্পুটা এখনও আছে। এর সাথে দোকান থেকে দিয়ে দিল বেটারা জানলা ৯৮। আমি তেমন কোন পার্থক্যই করতে পারলাম না, প্রথমের ছবিটা ছাড়া। ছোটখাট কিছু পরিবর্তন ছিল ৯৮ এ, তবে চলছিল ভালই, ৯৮ সালেই প্রথম পেলাম অন্তর্জালের সংযোগ। কিছুই বুঝি না, খুচিয়ে খুচিয়ে শিখতে লাগলাম, কিভাবে বার্তা পাঠায়, কিভাবে খুজতে হয় কিছু। ইয়াহু ছিল আমার প্রথম সার্চ ইন্জিন। তবে মিনিট হিসাবে বিল বিধায় বেশিক্ষন থাকতে পারি না সেখানে। ইউডোরা দিয়ে বার্তা ঠিক করে রাখি, ঢুকি, পাঠাই, বের হয়ে আসি। সংযোগ ছিল বি-ও-এল এর। খুব কমই আমাকে ২ বার ডায়াল করতে হয়েছে সংযোগের জন্যে। আর মেডিকেলে পড়াশুনা শুরু হয়ে গেছে, অন্যদিকে ফুটবল বিশ্বকাপ, আর প্রেমিকা, এই ফলে জানালা থেকে বেশ দুরেই সরে গেলাম যেন।

এর মাঝে মনে হয় বিল কাগুর গোপন স্থানে নানাবিধ অসুখ হয়েছিল, সারাদিন মনে হয় তার গা চুলকাতো, তাই সে বের করল মিলেনিয়াম এডিশনটা। কিন্তু আমি তার খবর পর্যন্ত পেলাম না, ভাগ্যিস, পাইনি। আর আমার সহপাঠিরা কেউ এ নিয়ে চিন্তিত না, তারা কম্পু চালাতে খুব একটা আগ্রহী না। তবে একজনের কাছে শুনলাম, এমন এক জিনিষ এই এম-ই, যে চালালে গান্ধিজিও রাম দা হাতে কোপাতে উদ্বুদ্ধ হবেন, আর দাঁত ভ্যাটকায়ে বলবেন, কোপাকুপি পরম ধর্ম। যাক, আমি এর পর হাতে পেলাম জানালা ২০০০। সম্ভবত এটা খুদেনরমদের বানানো একমাত্র ভালো জিনিষ। তার কারনটাও সম্ভবত এটা NT এর উপর ভিত্তি করে বানানো, সেজন্যে। এটা লাগানোর পর থেকে তো মহাবিপদের আবির্ভাব হল, কোন জিনিষ চলতে চায় না, কাউকে চিনতে চায় না, তবে একবার চিনিয়ে দিলে চুপ করে ঘর করতে থাকে। অন্তর্জাল থেকে ড্রাইভার নামিয়ে কাজ চালাতে লাগলাম। কিছু খেলাও ঝামেলা করত, কিন্তু তখন আমি খেলার উপরেও বেশ বিরক্ত। নিড ফর স্পিড ২ খেলতাম, বাসায় ২টা কম্পু তখন, নেটওয়ার্ক করা। ফিফা ৯৮ সহ আরো অনেক খেলা ২ কম্পুতে খেলি, মজাও অন্যরকম। এর মাঝে এন-এফ-এস ৩ আসল বাজারে, সে তো চলতেই চায় না, তখন জানলাম, এজিপিতে জোর না থাকলে, ব্যাটা মানুষের মাজায় জোর না থাকার মত হয়। আমি তো মহা হতাশ। সব খেলা খেলতে পারি না। এ কি জ্বালা, এই সব ভুং ভাং করতে করতে প্রথম বড় পরীক্ষা শেষ করলাম জীবনের।

পরীক্ষা শেষে আমার এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে নিয়ে বাসায় আসল "ছবি" দেখবে বলে। বুঝতেই পারছেন, কিসের ছবি, যাক, সে নাহয় দেখল, তার কাছে জানলাম, নতুন জিনিষ আসতেছে, তার নাম জানালা এক্সপি। আমি বললাম তাকে আমার ৯৫-৯৭-৯৮ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। সে বলল, আরে না, এটা খুব ভালো হবে, ড্রাইভার সংক্রান্ত জটিলতা দুর হবে পুরোপুরি এক্সপিতে। আমি যদি চাই, তার কাছে বেটা এডিশন আছে। আমি বললাম, বেটা বেটি বুড়া বুড়ি ছুড়া ছুড়ি বুঝি না, ভাই, মাফ চাই। কিন্তু আমার এই গোয়ার্তুমি বেশিদিন টিকল না। বছর ঘুরতেই এক্সপি হোমো করে ফেললাম, আমার মনে হয় না, আমি বিল কাগুরে কোন ক্ষতি করেছি, কিন্তু, এই জানালাটা এতই খারাপ ছিল যে কি বলব! নিজেই নিজেকে গাল পাড়তাম, আর কি বা করার আছে? কোন নিশ্চয়তা ছিল না, কম্পু চালু হবে কি হবে না, নানা ভাবে ক্র্যাক করলাম, কতবার যে ধুয়ে মুছে করলাম এক্সপি হোম, তার ইয়ত্তা নাই। দেখা গেল সব চলতেছে, তারপর হুট করে একদিন খুব জরুরী একটা কাজ পরে গেছে, হয়ত আমার বাবার একটা ক্লাস আছে কালকে, তার স্লাইড বানাতে হবে, এক্সপি বাবাজি ঐদিকে ভং ধরে বসে আছেন। কিছুই আসে না মনিটরের স্ক্রিনে। এভাবে মাস খানেক চলে গেল, হাতে পেলাম এক্সপি প্রফেশনাল। এর পরে যতদিন ঢাকায় ছিলাম, এমন একটা যন্ত্রনা করেনি কম্পু। আর আমিও কোন ঝুঁকি নিতাম না, ৩ মাস পরপর ফরম্যাট করে নতুন করে এক্সপি প্রো করে রাখতাম, যাতে করে কম্পুও টিপটপ থাকে।

এভাবে ভগিজগি করতে করতে আমার জীবন এগিয়ে গেল বেশ খানিকটা। ২০০৩ এ ডাক্তার হলাম, একা থেকে দোকা হলাম, ডিভিতে ভিসা পাইল বউ, ২০০৪ এ ইন্টার্নি শেষ করলাম, ২০০৫ এ এফসিপিএস পাশ করলাম, এই সময়ে বিল কাগুর জানালা এক্সপি খুব একটা ঝামেলা করে নাই। সে কোন প্রকারের কাশি দিলেই আমি বাজুকা দিয়া গুলি করতাম। ধর তক্তা, মারো পেরেক মার্কা অবস্থা, প্রচন্ড ব্যস্ত কাটতেছিল দিনকাল, সকালে কাজে যাই, দুপুরে আসি, বিকালে যাই, আসতে আসতে রাত ১২টা। ২০০৫ এর মাঝামাঝি চলে আসলাম বিল কাগুর দেশে। মারিকা আসলাম, কিন্তু আমার কম্পু আনতে পারি নাই একটাও, এত বই যে কি বলব, সব সুটকেস ওজন সীমার উপরে। যাক, এখানে এসে পিসি কিনলাম, আমি যে কত বড় ভোদাই, তার প্রমাণ স্বরুপ এইচ-পি এর পিসি কিনলাম, অনেক পয়সা পাতি খরচ করে, সাথে আসল এক্সপি হোম, কারন প্রো এর জন্যে ৯৯$ চায়, সব কোম্পানিই চায়। আর সাথে আনা প্রো লোডাইলাম না, কারন সেটা জেনুইন চেকে আটকায় যায়। যাক, দাত মুখ চাইপা চালাইতে থাকলাম হোম। আসল কপি হওয়ার কারনে সম্ভবত দেড় বছর বেশ ভালই চলল। এর মাঝে বাড়িওয়ালার পোলার কাছ থিকা টরেন্ট করা শিখলাম। তারপরে সেখান থেকে আস্তে আস্তে প্রো নামাইলাম, কিন্তু বিধিবাম, কাম করে না, সবই হয়, তারপর জেনুইন টেস্ট টপকাইতে পারে না। মহা যন্ত্রনা, এর মাঝে মাথায় এক কুবুদ্ধি আইল, এইচ-পির সাপোর্টে গিয়া কইলাম, আমার এক্সপি করা লাগব, হার্ড ডিস্ক ক্র্যাশ করসে, এখন কি করা? তারা কইল, পাঠায় দিতাসি এক কপি এক্সপি হোম এডিশন। সেইটা আবার যতখুশি করা যায়, খালি শেষে আমার কম্পুর গায়ে দেওয়া সিরিইয়াল্টা দিতে হয়। নানা ভাবে চেষ্টা কইরাও যখন প্রো এর অরিজিনাল কপি হাতাইতে পারলাম না, তখন আবার এইচ-পি রে কইলাম, আসলে আমার প্রো ছিল, আমারে প্রো পাঠাও, পাঠায় দিল, কিন্তু ব্যাটারা কত বড় বদমাইশ, সেটা ইনস্টল করতে গেলে বলে, তোমার কম্পুর জন্যে না এক্সপির এই ভার্ষন।

যাক, আমিও হোম নিয়া সুখে দুঃখে দিন পার করতেসিলাম, এর মাঝে কোল কম্পু কিনা ফালাইলাম, সেইখানে আইসা হাজির হইল বস্তা প্রিমিয়াম। কেবলে নতুন বাইর হইসে, ভাব সাবই অন্যরকম। যদিও কারো কাছে ভালো কিছু শুনি নাই, তাও আশায় বুক বাধলাম যে, এইবার নিশ্চই তারা ভালো কিসু বানাইসে বিল কাগু আর খুদেনরম। চালু করতেই দেখি বেশ ভুং ভাং, বেশ ঝকঝকে চকচকে আইকন, এবং মেনু গুলাও বেশ ভালো। কিন্তু এক্সপি চালাইতে অনভ্যস্ত, কেমন যেন খটকা লাগে সবকিছুতে। সবচেয়ে বিরক্ত হইলাম তাদের সবকিছুতে অনুমতি চাওয়ার বাড়াবাড়ি নিয়ে। আর রুট ড্রাইভে কিসু ভরতে চাইলে সরাসরি না করে দেয়। আমার কম্পু, আমার যেখানে ইচ্ছা, সেখানে খুশি ফাইল কপি করুম, তাতে তোর বাপের কি? কিন্তু দেখা গেল, তাতে বিল কাগুর নানা অঙ্গে দহন হয়, ফলাফল যা দাড়াইল, আমার যেখানে যেভাবে খুশি, কাজ করার স্বাধীনতা খর্ব হইল। সেইখানেই শেষ না, কিসু ইন্সটলাইতে গেলেই হালার মাথায় মাল উঠে, স্ক্রিন কালো হয়ে যার, কথা বার্তা বন্ধ করে দেয়। আর বুট করতে লাগে ৩ মিনিট, বন্ধ করতে গেলেও জ্বালা, ঘুমাইতে যাইতে লাগে ১ মিনিটের বেশি। আর ঝুইলা যায় অহরহ।

এইসব যন্ত্রনা কতক্ষন সহ্য হয় কন দেখি? কিন্তু কোল কম্পুতে আইসে বিধায় দাতে দাত চাইপা কাম করতে লাগলাম। ভাবলাম কয়দিন পরে সব সহ্য হইয়া যাইব। কিন্তু এযে বস্তা নয়, আসলে এতো বিষ্ঠা, খাস বিল কাগুর বিষ্ঠা, সহ্য হয় তো বদ হজম হয়। আরো কিছু জিনিষ লক্ষ করলাম যে, ২ দিন অন্তর অন্তর আপডেট আসে, কি নিয়া এত ভুজুং ভাজুং আল্লাহই জানেন। আমার মনে আছে। ৩ মাসে আপডেট আসছিল মনে হয় প্রায় ৮৬টার মতন, বস্তা আর অফিস মিলায়। আরো ভাবছিলাম, নতুন সিস্টেম, এই খানে তো ভাইরাস ধরব না। কিন্তু এত সুখ কি আমার কপালে আছে? ১ মাস যাইতেই দেখি বস্তা থিকা নানা রকমের যন্ত্রনা বাইর হইতে থাকে। আর এক্সপিতে ছোট ছোট সুবিধা ছিল ফাইল এক্সপ্লোরারে, সে সব সুবিধাও বিদায় করে দিসে। আর অন্যদিকে ব্যাপক হারে ড়্যাম খাইতেসে নিজের চাকচিক্য জাহির করার জন্যে। যখনই মাথা গরম হইত, তখনই মনে হইত মুইছা এক্সপি করি, তারপর কইতাম, থাক, আসল জিনিষ দিসে, এইটারে ফালায় ২ লম্বরি জিনিষ ভইরা কয়দিন শান্তিতে থাকুম?

২০০৭ এর মাঝামাঝি আর পারলাম না, ফরম্যাট কইরা এক্সপি করলাম, কিন্তু শালারা কত বড় বদমাইশ, কোন কিছুর ড্রাইভার পায় না। যেইটাই খুজি, কয়, তোমার কোম্পানিতে যাও, অর্থাৎ, এইচপি তে যাও, কিন্তু সেখানে বলে আমার ল্যাপির জন্যে ড্রাইভার শুধু আছে বস্তার জন্যে। আর গরমও যা হইত আমার ল্যাপি, মাঝে মাঝে মনে হইত, সামারা এর কোন ভাই বোন না হইলে এইচপির বিরুদ্ধে মামলা করুম। কাজেই ফিরা যাবার পথ বন্ধ, তাই আগের কম্পুতে ভুল কইরাও বস্তা করলাম না, দিনে দিনে বস্তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা হইতে থাকল। এক দোস্ত কইল লিনাক্সের কথা, কিন্তু হে আরো কইল, গেম গুলান চালাইবার পারবি না, তাই সে পথেও যাইতে পারলাম না। বইয়া বইয়া আঙ্গুল কামরাই, বিল কাগুরে গাইলাই। এর মাজেহ মাথায় আইল, মনে হয় বস্তার অন্যান্য ভার্ষন গুলা বোধহয় ভালো। টরেন্ট কইরা সব নামাইলাম, ব্যবসা, আল্টিমেট, বেসিক আরো কত কিছু। একে একে সবগুলাই চালাইলাম, সবচেয়ে বেশি দিন আমার ল্যাপিতে ছিল মনে হয় বস্তা বেসিক। এইটাতে আবর্জনা সবচেয়ে কম। এর মাঝে এক্সপি লোডায় বইল সারভিস প্যাক ৩ আমার ডেস্কটপে। তারপর তো আমার মাথার চুল ছেড়া ছাড়া আর কিসু করার উপায় থাকল না। আওয়াজ আসে না, ওয়াই-ফাই কাম করে না, এজিপিও ঝামেলা করে। আমার এক আইটি দোস্তরে জিগাইলাম, ঘটনা কি? হে কইল, আবার কি, এইটা দিয়া সবাইরে যন্ত্রনা দেবার ব্যবস্থা, যাতে কইরা সবাই বাধ্য হয় বস্তার মাঝে মাথা ঢুকাইতে। আমি কি কম খাটাশ! ফরম্যাট মাইরা লাইভ আপডেট বন্ধ কইরা দিলাম। যাই আসে, কাটা চামচ দিয়া খোচায় দেখি, এইডা ভরা ঠিক হইব কিনা? তারপরে লোডাই। এইভাবে কতদিন, একদিন আমার পত্নীদেবী ভুল কইরা হ্যাঁ বইলা দিল, আর সেই ধনন্তরি এসপি-৩ ঢুইকা বইসা থাকল। বেচারি সহজ সরল মানুষ, এইটুকু জানে যে, আপডেট তো মানুষের ঝামেলা কমানোর আর কম্পুর উন্নতির জন্যেই বানানো। নাহলে কি দরকার, ২ দিন পরপর এসব সরবরাহ করার! এখন চিন্তা করতে গিয়া মাথায় একটা প্রশ্ন আইল, আসলেই, বিল কাগুরে জিগাইতে মন চায়, উনি আসলে কি চান? মানুষ শান্তিতে থাকুক, নাকি বেহুদা অশান্তিতে থাকুক, তারপর দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে সাধারন মানুষ কাস্টমার সার্ভিসে কলাইবো আর তারা সার্ভিস দেবার নামে পয়সা লইব।

এইবার আর পারলাম না, বস্তা বেসিক ভরলাম ডেস্কটপে, তারপর দেখলাম, জানালা ৭ এর বেটা আইসে বাজারে, পুরানা অভিজ্ঞতা থিকা জানি, চকচক করলে সোনা হয় না, কাজেই ঐ পথেই পা বাড়াইলাম না। বস্তায় মাথা ভইরা দিন গুনতে লাগলাম, হয়ত কোন একদিন আসবে সেই সুদিন, যেদিন বিল কাগু ও-এস এর নামে ডিভিডিতে করে কাগু বেচবে না। কিন্তু বস্তায় মাল ভরলে সেটা যে কত ভারী হয় তা না ভরলে বুঝবেন কেমনে? এই ২০০৯ এ আইসা বস্তাও কুত পারতে শুরু করল। কম্পু বুটাইতে চায় না, ধীরে চলে, হ্যাঙ্গ করে, কিসু কপি পেস্ট মারতে গেলে কাপাকাপি করে, নেটওয়ার্কে ফাইল শেয়ার করতে গেলেও নানা যন্ত্রনা। এইদিকে ফরম্যাট মারতে পারতেসি না, বউ এর জিনিষ পত্র দিয়া ল্যাপি ভর্তি। আর লাইভ আপডেট তো আসতেছেই, বস্তা নতুন করে ভরার পর কম করেও ঘন্টা খানেক সে নেয় শুধু সময়ের সাথে তাল মিলাইতে। মহা বিরক্তিকর। আর আপডেট চলতে চলতে ভিড়িম করে সে রিস্টার্ট মারে, তারপর ভুলে যায় যে এ দুনিয়াতে আছে আমার কম্পু।

এর মাঝে ঘটল আরেক ঘটনা, আমার শালী ফোন করে জানাল যে, কালকে একটা ভৌতিক ঘটনা ঘটেছে, আমি বললাম, ধুর মাইয়া, দুনিয়াতে ভুত বইলা কিছু নাই। সে আমাকে বলে, না, আসলেই, কালকে রাত ৩টায় আমার কম্পু নিজে নিজে চালু হয়ে দৌড়ানো শুরু করসে, সে বেচারী একা থাকে, ভীষন ভয় পাইসে। আমি তারপর নিজের ল্যাপিতে খোচাখুচি করে বের করলাম, লাইভ আপডেট এর সময় রাত ৩টা, সারাদিন বন্ধ থাকলে সে রাত ৩টায় মাথা চাড়া দিয়া উঠবে সপ্তায় একদিন। আমি তো হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হবার জোগার। তাকে কিছু বললাম না। পরের আবার যখন সে আমাকে জিজ্ঞাস করল, কিসু পাইসি কিনা, আমি বললাম, এই ঘটনা কি ঠিক ৩টায় ঘটসে নাকি ১-২ মিনিট আগে পড়ে? সে তো ঘাবড়ায় গেসে, বলে, কেন? আমিও কম বদ নাকি? আমি বললাম, না মানে, রাত ৩ টায় তো উইচিং আওয়ার। আসলে তা না, মাঝ রাতের পর যে কোন সময়ে এটা হইতে পারে। হালকা চাপা ঝাড়লাম, সেই বেচারী তো ভয়ে ব্যাটারি খুলে ল্যাপি ব্যাগে ভরে ঘুমাইতে লাগল। মাস খানেক পরে প্রজাপতি আমার গোমর ফাঁস করে দিল জানতে পেরে।

সচলে এর মাঝে জানতে পারলাম যে লিনাক্স বা উবুন্টু এখন অনেক আগায়া গেছে, কিন্তু তাও ভরসা পাইতেছিলাম না। আর গেম গুলাও আরেকটা কারন ছিল আমার পিছুটানের। একদিন টরেন্টে দেখলাম, জানালা ৭ আল্টিমেট, দেখে বিশ্বাস হইতে চাইল না। নামায়া রাখলাম, কিন্তু ভরলাম না। বিল কাগুর কাছ থিকা ভালো কিছু আইতে পারে, এটা বিশ্বাস করা সম্ভব না আমার পক্ষে। এভাবে কাজ চালাইতেছিলাম বস্তা দিয়া, ২খান কম্পুতেই বস্তা, চারদিকে বস্তা, বস্তাই বস্তা। এর মাজেহ শাহান আসল ঢাকা থেকে, এসে কিনল ডেল স্টুডিও, তারেও দিল ডেল বস্তা ধরাইয়া। সে বেচারাও আমার সাথে সুর মিলাইয়া গাল পাড়তে থাকল বস্তারে। ২ সপ্তাহ আগে আমার ল্যাপিতে বস্তার তলা ফাইটা গেল, কাজেই ভিতরের সব জিনিষ বাহির হইয়া আমারে বিয়াফক গিয়ান্জামে বাঝায়া দিল। নিরুপায় হইয়া আমি জানালা ৭ করলাম, এইটা করার পর থিকা বেশ ভালই আছি, এখন পর্যন্ত কোন ভেজাল করে নাই। হয়ত বিল কাগু রাস্তায় আসছে, বস্তার ১৪ বার কইরা অনুমতি চাইবার ব্যাপারটা দুর হইসে। আপনে কম্পুর অ্যাডমিন, তারপরেও যখন কয়, আপনার অনুমতি নাই, তখন কেমন লাগে মেজাজটা। এগুলা ছাড়াও ছোটখাট আরো অনেক জিনিষে ৭ অনেক ভাবে উন্নত। তবে যে ব্যাপারটা বলতে চাই, সেটা হল, হ্যাকার ভাইরা জিন্দাবাদ। আগের সবগুলা বাইর হইত আসল জিনিষ বাইর হইবার পরে, ৭ বাইর হইসে রিলিজ তারিখেরও ২ মাস আগে।

তবে, এত কথা বলার কারন হইল, শাহান মিয়ার দেওয়া উবুন্টু। সব কিছু মাগনা, চিন্তা করলেই যেন কেমন লাগে। চাইলে মাগনা মাগনা বাসায়ও পাঠায়া দেয়, ফলে শাহান মিয়া মনের আনন্দে বিলি বন্টন করতেছে, এক কপি আমার ভাগ্যেও জুটল। হাতে যখন অযাচিত ভাবে এসেই পড়ল, তখন শামিম ভাইয়ের লেখাগুলা মাথার মধ্যে খুটমুট শুরু করে দিল, ফলাফল খুবই সহজ, দিলাম, ঢুকায় রমে। সিডি কইল, ডেডিকেট করে ইন্সটল করতে চাইলে বুট কর, আমি কইলাম, ঠিকাছে। দিলাম বুট কইরা। ইন্সটল করলাম, তারপর নিজে নিজে সব খুইজা নিল, একবারও কইল না, ঐ সফদার, ডেরাইবার পাই না তো। ঢুকানির সময় মনে হয় কিসু ভুলভাল টিপসিলাম, তাই হার্ড ড্রাইভে পার্টিশন নিয়া হালকা পাতলা ঘাপলা হইল। কিন্তু সেই ৯৫ থিকা বিল কাগুর লগে যুদ্ধ কইরা আইতাসি, এত অল্পে ডরাই নাকি আমি? পুরাপুরি শুরু থিকা যাত্রা শুরু করলাম, ফরম্যাট কইরা ফালাইলাম, জানালা ৭ তারপর উবুন্টু ৯.০৪. এক অভুতপুর্ব জিনিষ এই উবুন্টু। ২ দিন ধইরা এইটা নিয়া খুন্টুমুন্টু করলাম। তারপর খবর পাইলাম, অভ্রও আছে উবুন্টুর জন্যে, আর কে পায় আমারে। ফোরামে অভ্র ভরিবার তরিকা দেইখা ডরাইছিলাম একটু, কি কয় টার্মিনালে যাও, এইডা লেখ, ঐটা পড়, একটু ভয়ে ভয়ে করলাম, তারপরে হর হর করে কি কি সব কইল। আমি পাত্তা দিলাম না। লগ আউট করলাম, তারপর আবার লগ ইন করলাম, দেখি এক কান্চি দিয়া কিবোর্ডের আইকন উঁকি দিতাছে। একটা ক্লিক মারতেই তুমুল বেগে বাঙলা লেখা বাইর হইতে লাগল। এর জন্যে মেহেদি ভাইরে আবার একবার ধন্যবাদ দিতে চাই। সাইফুর রহমান বাংলা কইতে পারে না, তারে কিনা দেওয়া হয় একুশে পদক, আমার হিসাবে এই পদক প্রতি বছর দেওয়া উচিত মেহেদি ভাইরে।

উবুন্টু বুট হবার পর ৫ মিনিট লাগল ৮৪ টা জিনিষ আপডেট হইতে, কোন প্রোগ্রাম ভরতে চাইলেও তা ১-২ মিনিটের মাজেহই সমাধা হয়, বেহুদা, করবার পারবা, না, এদিক তাকাইবা না, তার লগে কথা কইবা না মার্কা কোন কথা কইল না। বুট হইতে সময় লাগে ৩০ সেকেন্ড, শীত নিদ্রায় যাইতে সময় লাগে ১৫ সেকেন্ড। উবুন্টুর গুনাবলি লেখার দরকার নাই, সেইটা শামিম ভাই বহুত বার কইসেন, কাজেই বস্তা বা জানালার ঝিক মিক দেইখা ভাই বোনেরা ধরা খাইয়েন না। আর উবুন্টু বুট করা মাত্র দৌড়ায়, বস্তা বা জানালার মত চালু হবার পর "আমাদের দেশের বড় কর্তার মত বিশেষ কামে ব্যস্ত আছি" মার্কা কথা কয় না। যেই মাত্র স্ক্রিন আইল, তখন থিকা রেডি আগুনে ঝাপায়া পড়ার লাইগা। বিল কাগুর জানালাগুলা সস্তা বারবণিতার সস্তা হাসির মতনই, পয়সা দিয়া কিনেন বা চোরাই কইরা উপভোগ করেন না কেন, দিন শেষে তারা আপনারে অসুস্থ করবেই। কাজেই সবাই পণ করেন, আইজ থিকা সবাই উবুন্টু ব্যবহার করবেন, সেই সাথে সবার আগে অভ্র লোডাইবেন, অভ্রের মত দারুন "নরমতার" মনে হয় না কাছাকাছি সময়ে বাইর হইসে!! তাছাড়া শুনলাম অভ্রের নতুন সংখ্যা আসিতেছে। আর চলেন সবাই বিল কাগুরে গিয়া কই, কম তো জানালা বাইর করলেন না, পয়সাও কম নিলেন না। লাভ কি হইল, ভালো কিসুই তো দিবার পারলেন না। কাজেই আমার কইতে মন চায়, "সব কটা জানালা ফেলে দাও না, আমি গাইব গাইব উবুন্টুরই গান"

পরমাণুগল্পঃ ডাগদরসাব

জনৈক ব্যক্তি একবার হাত কাটিয়া ফেলিলেন গ্যারাজ সাফ করিবার সময়, ব্যাপক হারে রক্তক্ষরন হইতে লাগিল, তিনি কি করিবেন বুঝিতে পারিতেছিলেন না। হঠাৎ করিয়া তাহার মনে পড়িল যে, তাহার ২ বাড়ি পরে এক ডাক্তার সাহেব থাকেন, এখন হয়ত তিনি বাসায় নাই, তারপরেও তিনি ভাবিলেন, যাইয়া দেখি, তিনি হয়ত বাসায় থাকিতেও পারেন। যেই না ভাবা, সেই না কাজ, তিনি সেখানে আসিয়া পরিলেন, আসিয়া কড়া নাড়িতেই ডাক্তার সাহেবের ৩ বছরের কন্যা আসিয়া দরজা খুলিয়া দিল। তাহার পরে সেই ছোট্ট বালিকা কি বুঝিল বিধাতাই জানেন, এতটুকু বাচ্চার কি বা বুঝার আছে, কিন্তু, সেই দেবশিশু তাহার কাটা হাত আর রক্ত দেখিয়া তাহাকে টানিয়া নিয়া একখানা আরাম কেদারায় বসাইয়া দিল, তারপর দৌড় দিয়া কাবার্ড হইতে তুলা নিয়া আসিয়া চাপিয়া ধরিল, তারপর উলটা তাহার কোলে উঠিয়া গল্প জুড়িয়া দিল।

সেই দেবশিশু নানা ভাবে ইনাইয়া বিনাইয়া তাহার গল্প বলিতে লাগিল, সে প্রতিদিন কি করে, তাহার কয়খানা পুতুল, কোন পুতুলের কি নাম, তার কোন পুতুল তাহার সাথে কি রঙ তামাশা করে। কোন পুতুল দিয়া সে কি খেলা করিয়া থাকে, কাহার কোন আচরণ তাহার ভালো লাগে না। তাহার মা কেমন ভাবে তাহাকে বকিয়া থাকে, ডে-কেয়ারে গিয়া সে কাহার সহিত কি দুষ্টুমি করে, এইসব বলিতে বলিতে প্রায় ঘণ্টা খানেক পার হইয়া গেল, এর মাঝে গল্প প্রসঙ্গে তাহার বাবার কথা আসিলে জনৈক ব্যাক্তির মনে পড়িল তিনি কেন এখানে আসিয়াছেন। কিন্তু এই দেবশিশুর আপ্যায়নে আর সেবায় তিনি সকল জ্বালা যন্ত্রণা ভুলিয়া গিয়াছিলেন। মনে পড়িয়া যাওয়ায় তিনি শিশুটিকে বলিলেন, তোমার বাবাকে একটু ডাকবে? সে বলল, বাবা তো বাসায় ই আছেন, আমি ডেকে আনছি। ডাক্তার সাহেব, এসে দেখলেন, এই বেচারার হাত দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে তখনো রক্ত পড়ছে, তবে খুবই ধীর গতিতে। তিনি আর তুলা সরাইলেন না, তাহাকে সরাসরি বলিলেন হাসপাতালে চলিয়া যাইতে। তিনি উপায়ান্তর না দেখিয়া ট্যাক্সি ডাকিয়া চলিয়া গেলেন হাসপাতাল।
doctor_funny

হাসপাতাল গেলে তাহার হাত সেলাই করা লাগিল, নানা রকমের ওষুধ পাতি দিয়া তাহাকে কর্তব্যরত ডাক্তার তাহাকে বাড়ি পাঠাইয়া দিলেন। পরের সপ্তাহে যখন তার ব্যথা বেদনা আর নাই, তিনি গিয়া হাজির হইলেন সেই ডাক্তার সাহেবের বাসায়, আবার কড়া নাড়িলেন, এইবার ডাক্তার ব্যাটাই দরজা খুলিয়া দিল, কিন্তু তাহাকে দেখিয়া জনৈক ব্যক্তির ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া গেল। ডাক্তার ব্যাটা ভাবিল, তাহাকে ধন্যবাদ জানাইতে আসিয়াছে মনে হয়, এই প্রতিবেশী। কিন্তু তিনি তাহাকে অবাক্‌ করিয়া দিয়া তিনি বলিলেন, আপনার কন্যা কই? তাহাকে ধন্যবাদ দিতে আসিলাম। এইবার তো ডাক্তার ব্যাটার অবাক্‌ হইবার পালা, কিন্তু, তিনি তাহাকে অবাক্‌ করিয়া বলিলেন, যার কাছ থিকা প্রকৃত সেবা পাইয়াছি, সেই তো আমার ডাক্তার, তাহাকেই ধন্যবাদ জানাইতে আসিয়াছি।

funny-doctor-cartoons-03-ss

doctor-funny

সেবা প্রকাশনী ও আমি

কালকে দ্রোহীদা আর কিংকু চৌধারির সাথে খোমাখাতায় বকবক করতে গিয়ে মনে পড়ে গেল সেই মধুর স্মৃতিগুলো, নানুর চোখ ফাঁকি দিয়ে সেবার বই পড়া আর নানা ফন্দিতে মাসুদ রানার বই সংগ্রহ করা, এখন পিছন ফিরে দেখতে গিয়ে দ্বীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। সেবার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় সেবা রোমান্টিক সিরিজের মাধ্যমে। বইয়ে নাম ছিল সম্ভবত ‘নিষিদ্ধ প্রেম’, গল্পের চরিত্র ছিল বাদল, যে কিনা তার চাচীর সাথে থাকে, আর তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। প্রথম পড়ি মনে হয় সপ্তম শ্রেণীতে থাকতে। সে রকম ছিল বইয়ের কাভার। তখন আমি রাজশাহীতে থাকি, বইটা হাতে আসে আমার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে, এর পরে পড়ি “ব্রাম স্টোকার এর ড্রাকুলা”, এক পর্যায়ে গিয়ে এতটাই ভায় পেয়েছিলাম যে, ভাইয়ার পাশে বসে পড়েছি বাকিটা। কি অসাধারন সেই অনুবাদ গুলো, ভাবলে মন উদাস হয়।

রাজশাহীতে থাকতে কেন যেন মাসুদ রানার সাথে সাক্ষাত হয়নি, অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার পরে ঢাকা চলে আসি আমি আর আমার ভাইয়া। আমার বাবা-মা চলে যান বরিশাল চাকরির টানে বদলি হয়ে। আমার ভাইয়া তখন বুয়েটে ভর্তি হয়েছেন। আমরা ঢাকায় এসে উঠি পশ্চিম রাজাবাজারে ছোট্ট একটা বাসায়। ঠিক হল, আমি ঢাকায় রেসিডেন্সিয়াল মডেলে ভর্তি হব, যেহেতু তারাই একমাত্র পুরোপুরি আবাসিক। ঢাকায় এসে আমার স্কুল নাই, কিছু নাই, সারাদিন সিনেমা দেখার বাতিক হল। একটানা ৫-৬টা করে সিনেমা দেখতাম। পাড়ায় কোনার ভিডিও দোকানে গিয়ে ৩-৪ টা সিনেমা আনতাম, তারপর দেড় ঘন্টা পরে গিয়ে একটা পালটিয়ে আনতাম, বলতাম, এটা পছন্দ হচ্ছে না। যাক, এভাবে ধানাই পানাই করে দিন কাটাচ্ছি, এর মাঝে হাতে আসল আরব্য রজনীর ৯টা বইয়ের সিরিজ। তখন আমার নানু থাকেন আমাদের ২ ভাইয়ের সাথে।

তার সামনে তো আর এই বই পড়তে পারি না, বইয়ের উপরে বড় বড় করে লেখা, প্রাপ্ত বয়ষ্কদের জন্যে। মহা বিপদ, বইয়ের মাঝে রেখে রেখে পড়ি, নানুকে দেখলেই লুকাই, এভাবে পড়ে যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ করে মাথায় বুদ্ধি এল, বাথ্রুমে ঢুকে পড়লাম, আধাঘন্টা পরে নানু যখন এসে বলল, কিরে, এখনো ভিতরে? আমি বললাম, “পেট খারাপ”। কিন্তু একই বুদ্ধিতো আর রোজ খাটে না। রোজ রোজ নানান ফন্দি ফিকির করতে থাকি, অপেক্ষা করি, কখন নানু ভাত খেয়ে ঘুমাবে, তখন খোলা ময়দানে আরাম করে পড়ব বই। ভুং ভাং করতে করতে চলে আসে বার্ষিক পরীক্ষা, তার লেজ ধরে ভর্তি পরীক্ষা, পরীক্ষায় উতরে যাই, ভর্তি হয়ে যাই নবম শ্রেনীতে। এখানে এসে বন্ধুত্ব হয় রনি নামে ২ জনের সাথে। একজন ভাঙ্গা রনি, অন্যজন বিড়ি রনি। বিড়ি রনি একদিন হঠাৎ করেই একখানা মাসুদ রানা এর বই নিয়ে হাজির, শেষের বেঞ্চে বসে রনি পড়তে থাকে, আমার ও খুব আগ্রহ হয়, নিয়ে আমি পড়ার চেষ্টা করি, কিন্তু ঠিক ধরতে পারি না, কোথা থেকে কোন দিকে যাচ্ছে ঘটনা। সেদিন ধর্ম ক্লাসে আমাদের হেড মওলানা স্যার সেই বইটা হস্তগত করেন, তারপর নিজে পড়তে পড়তে নিজের রুমে ফেরত যান।

কি কারনে জানি না, কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা হল, কি এমন বই যে, স্যার মেরে নিয়ে নিজেই পড়তে লাগল। বাসায় ফেরার পথ ফার্মগেটে একটা বুক্সটল থেকে কিনে ফেললাম “হ্যালো সোহানা”, আমার পড়া প্রথম মাসুদ রানা। সেই যে শুরু হল, পড়তে গিয়ে বারবার হোচট খেতে লাগলাম, অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে, যার কোন হাতামাথা নাই। যাক, পরেরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে গেলাম ফার্মগেট, গিয়ে কিনলাম ১-২০, ধ্বংস পাহাড় থেকে জাল। ধ্বংস পাহাড় পড়েই তো আমি পুরা কাইত। আহা! কি বই! তখন থেকে আমি কবীর চৌধুরির বিশাল ফ্যান হয়ে গেলাম। ১-২০ পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি, তখন তো স্কুলে সারাদিন মাসুদ রানা, বাসায় ফিরেও সেই একই কথা। আর হায় হায় করতে থাকি, এতদিন কি করেছি, কত বই বের হয়ে গেছে। তখন মনে “আমি সোহানা বের হওয়া শেষ বই। কিন্তু আমি তো পুরাই নেশাগ্রস্তের মত পড়ে যাচ্ছি। তারপর আবার গিয়ে হাজির হই ফার্মগেট, তেজগাও কলেজের গেটে একটা বুক্সটল আছে, সেখান থেকেই কিনতাম সব বই। ততদিনে আমার চেহারা চিনে ঐ দোকানি, গেলে আমাকে সেবার একটা লিস্ট দেন, যত বই বের হয়েছে, তার, সেটা থেকে আমি বলি ২১-৫০ পর্যন্ত যেটা যেটা আছে, সেই বই গুলা দেন। সে মাথা চুলকে বলে, আসলে এখানে অনেক বই নাই, মানে হয়ত ২৯-৩০-৩১ একসাথে, কিন্তু, ৩০ নাই, ছাপায় নাই সেবা প্রকাশনী বহুত দিন।

আমার মাথায় হাত দেওয়া ছাড়া আর কিছু কতার থাকল না, ভেবেছিলাম, সিরিজ ধরেই পড়ব, কিন্তু কি করা, বললাম, যেগুলা সেট আছে, সেগুলা দেন। এইভাবে প্রথম ৭০ টা বই কিনি ৩ ধাপে। হাতে খুব বেশি টাকা থাকে না, এজন্যে একবারে বেশি বই কিনতে পারতেছি না। এই ৭০ টার মধ্যে কম করেও ২০ টা বই এর ফাঁক ছিল। কিন্তু, আমি নিরুপায়, এর মাঝে ফেব্রুয়ারী মাস আসল, আমি গেলাম সেবা প্রকাশনীর স্টলে, এরা অনেক ডিস্কাউন্ট দেয় দেখে এখান থেকো কিছু বই কিনি, আর ঐ ২০টার মধ্যে থেকে, বেটারা বলে, তাদের কাছেও নাই ঐ বইগুলা। মনে মনে গাল পাড়তে পাড়তে বাসায় চলে আসি, আর মাসে ১ বার করে যেতে থাকি ফার্মগেটের ঐ স্টলে, এভাবে গড়ে উঠতে থাকে আমার কলিম রানা থুক্কু মাসুদ রানার সংগ্রহ। কিন্তু এর ফাক ফোকর দিয়েও কত বই বাদ পড়ে যেতে থাকে, সেবা ছাপে না, দোকানদারের কি দোষ? আমিও প্রতিবার গিয়ে লিস্ট আনি, এনে আগের লিস্টের সাঠে মিলাই, কাটাকাটি করি।

ফুফাতো ভাই আমার মোট ১৫ জন, একজন আমার ১ বছরের ছোট, সে বুদ্ধি দিল, নিলক্ষেত গিয়ে খোজাখুজি করার, তাকে নিয়েই গেলাম, ভাগ্যক্রমে খুজে ৮টা বই পেয়ে গেলাম ফুটপাতের বিভিন্ন দোকান থেকে, সে সময় আর নতুন পুরান, পরিষ্কার ময়লা বুঝি না, সিরিজ শেষ না করে শান্তি পাচ্ছি না। তারপর প্রায় আরো ২ বছর লেগে যায় আমার ২৫০ বই কিনতে। কিছু ফাঁক তখন ও আছে, কিন্তু, যা কিনেছি, সব বই পড়ে ফেলেছি, কাজেই আবার শুরু থেকে শুরু করার ইচ্ছা হল, কিন্তু, এর মাঝে মেট্রিক পরীক্ষার প্রিটেস্ট এসে হাজির। কাজেই পাজী আনোয়ার হোসেন কু-ডাক উপেক্ষা করে মাসুদ রানার মুখে বোরখা পড়িয়ে ধুমসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকি। প্রিটেস্ট শেষ হয়, কিন্তু তখন পরীক্ষায় ভয় ঢুকে গেছে মনে। কাজেই টেস্টের আগ পর্যন্ত সকল মাসুদ রানা বাক্সবন্দি করে রাখি, যাতে করে নেশার বশে আবার শুরু না করি।

টেস্ট শেষ হবার পরেই ফার্মগেট গেট হাজির হই, আর লিস্ট মিলিয়ে যা পাই, কিনে ফেলি, তখন আমার এমন অবস্থা, দোকান্দারকে বলি, সেট হওয়া লাগবে না, ২ খন্ডের ১ টা থাকলে সেটাই দিন। এভাবে আমি প্রায় ২৫০ এর মধ্যে থেকে ২৪০ টার মত বই সংগ্রহ করতে সমর্থ হই। আর অপেক্ষা করতে থাকি, কবে বইমেলা শুরু হবে, সেবা নতুন করে পুরান বই ছাপবে, হয়ত সেখানে আমার না থাকা বইগুলাও পাওয়া যাবে। সেখানে গিয়েও আধাখেচরা করে বই কিনতে থাকি, আর অসম্পুর্ন ভাবে গল্পের ১ পর্ব পড়ে নিজেকে গালি দিয়ে ভুত তাড়ানোর অপচেষ্টা করতে থাকি। আর নিলক্ষেতের আশে পাশে গেলেই ফুটপাতে চোখ রাখতে থাকি, ততদিনে আমার মানিব্যাগে একটা লিস্ট এসে গেছে, যে ১০ টা বই নেই, তার নাম নিয়ে নিয়ে ঘুরি, কোথাও যদি পাওয়া যায়। বইয়ের পিছনে যখনই চিঠিপত্রে আগের বইয়ের উল্লেখ থাকত, তখনই মেজাজ খারাপ হয়ে যেত, যে এই বইটাতো পড়ি নাই এখনো।

মাসুদ রানার বাজারে পাওয়া সব বই শেষ, এখন কি করি, এর মাঝে চোখে পরে কুয়শা, আর কিছু না, খালি কাজীদার নাম দেখেই কিনে ফেলি ৫টা সমগ্র। কুয়াশার সমগ্র ১-২-৩, ৪-৫-৬ এভাবে ছাপানো। প্রথম গল্পটা পড়েই আমি বুঝে যাই, এ তো আমাদের কবির চৌধুরির “যদি সফল হত” আর “পরোপকারী” হত, তাহলে কেমন হত! কুয়াশার ৭৬ টা বই মনে হয় এক নিঃশ্বাসে পড়েছি, এতই ভালো লেগে গেল যে, শেষ করেই আবার শুরু থেকে শুরু করি। প্রথম পড়ায় যদি মজার কিছু বাদ পড়ে গিয়ে থাকে। মজার কথা হল, কুয়াশা সিরিজ কিন্তু মাসুদ রানার ও আগে শুরু করা। পাকি আমলে কাজীদা ১৯৬৬ সালে লেখেন প্রথম কুয়াশা, তারপর মাসুদ রানার প্রথম বই ধ্বংস পাহাড় লেখেন সম্ভবত ১৯৬৭ সালে। নতুন রানা আসছে না, এ দিকে কুয়াশা লেখা বন্ধ করেছেন কাজীদা ১৯৮৪ সালে। মনে মনে বলতে থাকি, এই ব্যাটার থামার আর সময় জুটলো না। আর বছর পাঁচেক লিখলে কি অসুবিধা ছিল?

এর পরে ধরে ৩ গোয়েন্দা, রকিব হাসান মিয়া আসলে দুধভাত, কুয়াশা আর রানা পড়ার পরে কেমন পান্সে পান্সে লাগত। কিন্তু সেবার টানেই বার বার ফিরে ফিরে আসতাম আর আবাল ৩ গোয়েন্দা পড়তাম। তবে প্রথম ৬০টার মত ৩ গোয়েন্দা বেশ ভালোই ছিল, তবে তারপর কেমন যেন পেট খারাপ হয়ে গিয়েছিল রকিব হাসানের। কোন ভাবে জোড়াতালি দিয়ে কোন মতে বই দাড় করাতে পারলে যেন বর্তে যাবেন তিনি। ১০০ এর পরে আর সম্ভব হয়নি ৩ গোয়েন্দা হজম করা। কাজেই সেটা বাদ দিয়ে আবার মাসুদ রানা শুরু করি, পরের বারের বই মেলায় গিয়ে দেখি, সেবা সব বই আবার ছাপানো শুরু করেছে। কি মনে করে রানা ১-২-৩ তুলে নেই, পরতে থাকি স্টলে দাড়িয়েই, ১ পাতা পড়তেই কেমন যেন লাগতে থাকে। বুঝতে পারি, রানা তে প্যারেন্টাল গাইডেন্স বসানো হয়েছে। কার উর্বর মস্তিষ্কের থেকে এই বুদ্ধি আসল, কে জানে? এই বই মেলায় আর কোন ফাঁক থাকে না, সব বই পেয়ে যাই।

একটা জিনিষ আমাকে খুব বিরক্ত করেছিল, সেটা হল, মাসুদ রানার বয়স যদি স্থির থাকে, তাহলে তার বন্ধু সোহেল, তার বস রাহাত খান কেন বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন, আর আরেকটা জিনিষ হল যে, অমুক সময়ে সে কেউকে সাহায্য করেছে, তার ছোট বোন ছিল, ঘটনা চক্রে আমাদের রানা সেই মেয়ের সাথে প্রণয়ক্রিয়াতে লিপ্ত হচ্ছে, আগে ছোট ছিল, এখন বড় হইসে, আমি তো বড় হই নাই, এমন একটা ভাব। কতটা জরুরী ছিল এই ভাবে লেখার? আর স্পাই মানুষ, বনে জঙ্গলে তার ঘুরে বেড়ানো মানায় না, কিন্তু অনেকবারই সে ফিরে গেছে আফ্রিকার জঙ্গলে, সম্ভবত, কাজীদা তখন কোন গল্প খুজে পাচ্ছিলেন না, কিন্তু বই বেরুলেই মানুষ কিনবে, তাই শিকার কাহিনী অনুবাদ করে বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়েছেন।
বইয়ের পাশাপাশি যে জিনিষটা টানত, সেটা হল, চিঠিগুলো, কতবার ভেবেছি, চিঠি লেখব, যদি ছাপা হ্য়, কিন্তু আসলে কখন ও লেখা হয়ে উঠেনি। তবে একটা চিঠির কথা মনে আছে, তখন মনে হয় রানা এর ৩২০ এর দিকের বই বের হচ্ছে, একজন চিঠিতে লিখলেন, “শুনলাম, সেবাতে নাকি এখন মাসুদ রানা কাজীদা লিখেন না, লিখে সেবার দারোয়ান”। কথাটা যে সত্যি, তাতে কোন সন্দেহ নাই, তবে, সম্ভবত তার খুব গায়ে লেগেছিল, ফলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “সেবাকে এতদুর চালিয়ে আনার জন্যে সেবার দারোয়ানের অবদান কোন অংশে কারো চেয়ে কম নয়”। চোরের মায়ের বড় গলার মতন শুনালেও কথাটা কিন্তু ২ দিক থেকেই সত্যি। আমার মত যারা একনিষ্ঠ ভুদাইচরিত পাঠক, তারা ভুয়া বই পড়ে বিরক্ত হচ্ছেন, কিন্তু আমাদের কাজীদার ও বোঝা উচিত, গত ৪৩ বছর ধরে মাসুদ রানা ২৯ বছ বয়সে আটকে আছে, এবার বেচারা এক্সিডেন্ট বা হার্ট এট্যাক বা কবির চৌধুরির গুলি খেয়ে মরার হয়ে গেছে।

নব্য রাজাকারের সাদাকালো চোখে রঙিন দুনিয়া

প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে দৌড়াই নিউজার্সির পানে, মাথায় ঘুরে নানা রকমের চিন্তা ভাবনা। আসলে বাইরে অনেক ঠাণ্ডা থাকায় কাঁচ নামাতে পারি না, অনেক ঠাণ্ডা লাগে, কাজেই ভেতরে থাকে প্রায় সুনসান নীরবতা। এই সময়টা তাই ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করি। এখনো অবাক্‌ হই যে আমাদের দেশে এবং বিদেশে উড়ে নরপিশাচদের পতাকা, ঘুরে বেড়ায় তারা ভদ্র মানুষের মুখোশে, আর তারচেয়েও ভয়ংকর হল যে, এরা আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে আমাদের মাঝে। পাল্টে নিচ্ছে নিজেদের প্রকাশভঙ্গী, ভাবটা যেন, তারা আমাদেরই একজন। অথচ প্রথম থেকেই এরা যুদ্ধ করে যাচ্ছে আমাদের ভাষা, আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, এরা চায় আমরা পাকিদের গোলাম হব, আর যদি মাথা নত না করি, আঘাত হানে পঙ্গু করে দেবার জন্যে। জানি না কীভাবে এদের শেষ হবে, কবে এদের শেষ হবে কিংবা আদৌ এদের শেষ হবে কিনা। যখন একা একা এভাবে ভাবি, গা হাত পা অবশ হয়ে আসে, মনে হয়, যদি পেতাম বেটা গো-আ কে গাড়ির সামনে, ধুম করে চাপা দিয়ে চলে যেতাম।আমার আজকের লেখাটা নিতান্তই আমার অনুর্বর মস্তিষ্কের কিছু অর্থহীন চিন্তাভাবনা। কোন সত্যতা নাই, কোন তথ্য প্রমাণ নাই, পুরোপুরি বানোয়াট। আসুন আমার সাথে কাল্পনিক এক রাজাকারের ভ্রান্ত ধারণা দেখার একটা চেষ্টা করি, হয়ত পারব না দিতে কিছুই, যদি কারো খারাপ লাগে, তার জন্যে আগে ভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

আমার হিসাবে রাজাকারেরা শুধু ২ দলের মানুষ চিনে, নিজের দল, আর বিপক্ষ দল, আর তাদের খোরাক হল ধর্ম নামের ভ্রান্ত ধারণা। ধর্মের সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই, অথচ ধর্মের নামে এরা ছুরি চালায়। এরকমই একজন বক ধার্মিকের সাথে পরিচিত হই, ধরেন তার নাম বেলাল। গালে তার এক ছাগলা দাড়ি, চোখে সুরমা, গা থেকে আসে আতরের খোশবু। আসেন তার চিন্তা চোখ দিয়ে একটু দুনিয়াটা দেখি। আবারও বলে নেই, এটা নিতান্তই একটা কাল্পনিক চরিত্র। কারো সাথে কোন মিল পাওয়া গেলে তা একবারেই কাকতালীয়।

বেলাল সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের আজান শুনে, উঠে চারদিকে তাকায়, মনে পড়ে যায়, সে থাকে ২ কাফেরের সাথে রাজশাহী চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের হলে, এত থাকতে কিনা তাকে থাকতে হল ধর্মের নামে বিধর্মী এই দুই মানুষের সাথে, আল্লাহ খোদার নাম নাই, সারাদিন খালি হৈহুল্লা, আমার তার পিছনে তাকে কিনা তারা গালাগালি করে। জীবনে দেখল না সে তাদেরকে একদিনও ঘুম থেকে উঠতে। ফজরের আজানে নাকি তাদের ঘুমের অবসুবিধা হয়। কতবড় কথা। পারলে সে আজকেই এদের রগ কেটে রেখে দিত। যাক, এদের দিয়ে কোন ভবিষ্যত নাই, প্রথম প্রথম সে এদেরকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছিল, সে জন্যে তাকে তারা কতভাবেই না লাঞ্ছনা গঞ্জনা করল, সহ্য হয় এসব?

সকালে উঠে সে প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে তৈরি হয়, ক্লাস শুরু হবে ৭টায়, সেখানেও আসবে যতসব ধর্ম সম্বন্ধে উদাসীন লোকজন, এদের মাঝে তার যেন দম বন্ধ হয়ে আসে, কীভাবে যে এমন হল, তার দেশ পাকিস্তান কীভাবে যে আলাদা হয়ে গেল, কোথাকার কোন নেতা এসে ডাক দিল, আর সবাই তার সাথে করে মেরে পিটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে কিনা বানিয়ে দিল বাংলাদেশ, এটা কোন নাম হল? নেতা হবে তো নিজামী বা গোলাম আযমের মত নুরানী মানুষ, আহা কি অসাধারণ না তার ব্যক্তিত্ব, মানুষ জবাই করার সময় ও তার হাত কাঁপে না একটু। কত কাফের যে জবাই দিল আমাদের এই মহান নেতা। আর তার চেহারায় কি রোশনাই, দেখলেই যেন তুর পাহাড়ের জেল্লা দেখা যায়।

ক্লাস শেষে গজ্‌গজ্‌ করতে করতে বের হয়ে আসে বেলাল, বের হয় যেন দম ফিরে পায়, আগামী ২ ঘণ্টা কোন ক্লাস নেই, এই ফাঁকে নতুন ভর্তি হওয়া পুলাপাইন গুলাকে যদি একটু দীনের আলো দেখানো যায়। এই ভাবতে ভাবতে সে ক্যান্টিনে গিয়ে হাজির হয়, দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে গিয়ে হাজির হয় একটা জটলার মাঝে। গিয়ে সালাম দিয়ে কথা শুরু করে সে, বলে, আসেন ভাই, আপনাদের মাঝে কেউ যদি আগ্রহী হন, আমরা একটা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে বই বের করতে যাচ্ছি, সেটা নিয়ে কেউ কাজ করতে পারেন। আমরা পুরান প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করি, তারপর তা একসাথে ছাপাই, আমাদের উদ্দেশ্য মহৎ, আসেন ভাইয়েরা, আমাদের মত ছাত্র যারা, তাদের পড়াশুনার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসুন, বিনিময়ে টাকাও পাবেন কিছু। এমন বড় কোন পরিমাণ না, তবে কয়েকদিনের চা নাস্তা তো হবে। আর মনে মনে হাসে, এসব কাজ টাজ সব ভাঁওতা, বেটা, খালি আয় মীটিং এ, মগজ ধোলাইয়ের জন্যে বিগ বস করিম ভাই তো আছেই, এক মাসের মধ্যে দীনের শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে যাবি। কিন্তু রকিব নামের একটা ছেলে ফট করে বলে ফেলে, যা বেলাল, তোর মত ফ্যানাটিক দলে কাজ করবার কোন আগ্রহ এখানে কারো, মিয়া দিনের বেলায় এক বেশ, আর মওকা পাইলেই তোর মাঝের ২ নম্বরী সত্বাটা বাইর হইয়া আসে।

মাথায় যেন আগুন ধরে যায় বেলালের, ব্যাটা কাফের বলে কি? প্রথম দিন থেকেই এই ব্যাটা তাকে নানাভাবে আজেবাজে কথা বলে সবার সামনে যার পর নাই নাজেহাল করে যাচ্ছে, নাহয় ব্যাটা পড়াশুনায় ভালো তাই বলে এভাবে আকথা কুকথা বলে তাকে অপমান করবে? করিম ভাইকে বলতে হবে, এই হারামাজাদাকে সাইজ না করলে আর চলছে না। আজকে রাতেই কথা বলবে। এরপরে সে গিয়ে হাজির হয় তার এক বন্ধুর সাথে, কাছে যেতেই সে সালাম দিয়ে কোলাকুলি করে, তারপর দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে দুজনে ২ চেয়ার নিয়ে বসে। তারপর শুরু হয়, আজকে কে কোথায় কি দেখেছে, একে অপরকে বলতে থাকে, মোটামুটি আধাঘণ্টা খবর বিনিময়ের পর কথা প্রসঙ্গে রাজনীতি চলে আসে, এখনো তারা ভুলতে পারে না, শেষ নির্বাচনে কি হল? এভাবে দেশের মানুষ তাদের অপমান করল, তার যদি ক্ষমতা থাকত, এসব লোকদের একপাশ থেকে ধরে জবাই করে মাংস হিসাবে চীন দেশে পাচার করে দিত। সে শুনেছে, চৈনিকরা নাকি খায়না এমন কিছু নাই। সেবার যমুনা ব্রিজ বানাতে এসে এলাকার সব কুকুর, সাপ, ব্যাঙ খেয়ে সাফ করে ফেলেছিল। তার এই মত প্রকাশ করতে তার বন্ধু তাকে ঠিক করে দেয়, আসলে ওরা চীনা ছিল না, কোরিয়ান ছিল। বেলাল বলে, যে দেশেরই হোক, সবই তো চাঙ্কু, এরা আবার মানুষ নাকি, কেমন পোকার মত, সাদা সাদা, চেপটা চেপটা।

যাক, তারপর তার বন্ধু খবর দেয়, আজকে রাতে কিন্তু করিম ভাইয়ের সাথে মীটিং আছে। তারা একে অপরকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যায় যে যার পথে। বেলালের ক্লাসের সময় হয়ে গেছে, সে আবার হাঁটা ধরে, এ ক্লাসটা তার খুব পছন্দ, যিনি ক্লাস নেন, মহান ব্যক্তি, তিনি তাদের দলের সাথে যুক্ত, বহুদিন থেকেই, উড়া খবরে শুনেছে, ছাত্রজীবনে নাকি সে অনেক বড় কর্মী ছিল, এক ছাত্রকে সে নাকি ধীরে ধীরে গিরা ধরে ধরে আলাদা করেছে, কেউ তার টিকিটাও স্পর্শ করতে পারেনি। এখন অবশ্য তাকে দলের স্বার্থেই এসব করতে দেওয়া হয় না, তার একটা সামাজিক স্থান আছে, তার কাজ এখন আরো বড় বড় কাজ করা। বেলালের খুব ইচ্ছা তার মত কাজ করার। যাক, হয়ত সে সুযোগ আসবে কোন একদিন। আগে কি দিন ছিল, কথায় কথায় উনারা রগ কেটে ফেলতেন, এখন আর সে দিন নেই, সবাই নাকি সচেতন হয়ে গেছে, খুব নাকি ভেবে চিন্তে কাজ করতে হবে। এই নিয়ম আর বাধা তার ভালো লাগে না। এসব চিন্তা করতে গিয়ে চোখ চকচক করতে থাকে তার।

স্যারের ক্লাস শেষ হয়ে, আবারো বের হয়ে মনে মনে বলে, আহা কি সুন্দর করেই না কথা বলেন তিনি, কত সুন্দর করেই না বুঝান, কোন দিন যদি তার মত হতে পারেন। আবার ক্যান্টিনে ফিরে আসে সে, পত্রিকা তুলে নেয়। পত্রিকা পড়তে ইচ্ছা করে না আর। সারাদিন ২ বেহায়া বেটি গলায় গলায় ঝগড়া করে, মাইয়া মানুষ, ঘরে থাকবে, সংসার করবে, স্বামীর খেদমত করবে, তা না, তেনাদের কত রকম ত্যানাপ্যাচানি। দেশ গোল্লায় না গেলে যাবে কই? রমযান মাস গেল, সাথে সাথে গেল তাদের মাথার কাপড়। কত্তবড় বদমাইশ, চিন্তা করতে করতে বেলালের মাথাটা গরম হয়ে যায়। ২ নেত্রীর একজন তাও তাদের দলের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবে তার মতে, ক্ষমতায় কোনদিন তাদের বড়নেতা যদি আসতে পারেন, ২ বেটিকেই ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। গুপ্ত হত্যা করতে হবে, দেখাতে হবে সবাইকে যে, কোন দুর্ঘটনায় মারা গেছে এরা। অপেক্ষা আর ভালো লাগে না তার।

দুপুরে খেতে তাকে যেতে হবে হলে, যাবার পথে আবার রকিবের সাথে দেখা হয়ে যায়, দেখা হতেই টিটকারি মারে রকিব, সে তাকে দেখিয়ে বলে, দেখ দেখ, ছাগলা দাড়ি যায়। যান বেলাল ভাই, বেশি করে দোহন করেন, দেখেন দীনের আলো বের হয়ে আসতে পারে। না, আর তো পারা যায় না, সেদিন তার রুমমেটের সাথে দেখা করতে এসেছিল রকিব, এসে কত হইচই, তারপর তারা তার লুঙ্গির মাঝে ফুটা করে রেখে গেছে, তার তোষকে পানি ঢেলে রেখে গেছে। রাতে শুতে গিয়ে বেলাল লাফ দিয়ে উঠে এসেছে। পরে যখন সে তার রুমমেটকে ধরেছে, সে স্বীকার করেছে যে, এই কুকাজ রকিবই করেছে। হলে আসতে ১০ মিনিট সময় লাগে, খেয়ে দেয়ে বেলাল রুমে এসে একটা রিপোর্ট তৈরি করে, আজ রাতে বলতে হবে, করিম ভাইকে, কাকে কাকে কিভাবে দুর্বলতা সুযোগ নিয়ে দলে ভেড়ানো যায়, কার অভাবের টান বেশি, সাহায্যের নাম করে প্রথমে কাছে টানতে হবে, তারপর আস্তে আস্তে মনের ভেতরে জায়গা করে নিতে হবে, তারপর একদিন ঐ ব্যাটা ভোদাই জানবেও না সে তাদের দলের কর্মী হয়ে গেছে। এই সপ্তাহে সে সম্ভাবনাময় কয়েকজন কে খুঁজে পেয়েছে। আর ৩ জন কে দলে ভেড়াতে পারলে সে অন্যদের থেকে এগিয়ে যাবে। তখন তাকে আরো বেশি ক্ষমতা দেওয়া হবে, এই সুযোগের জন্যে কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে। এই দোকানদারি আর ভালো লাগে না তার।

তার ক্লাসের সহপাঠিদের মাঝে মেয়ে এবার অনেক বেশি। এ ব্যাপারটা তার খুব গা জ্বালা দেয়, সব কাজ সবার জন্যে না, লেখাপড়া করা কি মেয়েদের কাজ? তারপর আবার পাশ করে অনেকে কিছুই করে না, ঘরে বসে থাকে, ঘরেই যদি বসে থাকবি তো, এখানে আসার কি দরকার ছিল? একটা ভালো বিয়ে করার জন্যে এখানে আসার কি দরকার? এ ব্যাপারটাও বড় নেতার নজরে দেওয়া দরকার। মেয়েগুলা দিন দিন কেমন বেহায়া হয়ে উঠতেছে, কি তাদের বেশভুষা, অবশ্য একটা মেয়েকে তার খুব ভালো লাগে, কি সুন্দর বোরখার আড়ালে মুখ ঢেকে আসে, তাকে দেখলেই বেলালের হৃদয়ে পাখি কুউ কুউ ডাকে, সে পাশ করেই এই মেয়েটাকে বিয়ে করবে, এ কথা চিন্তা করতেই সে উত্তেজিত হয়ে যায়, আরো বেশি বেশি দাড়িতে হাত বোলাতে থাকে। আর বেশি না, ৪ বছরেই তার পড়াশুনা শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু এর মাঝে কেউ যাতে কুদৃষ্টি না দেয়, এজন্যে তাকে জানাতে হবে তার মনের কথা। আর সে চায়, বিয়ে করে তার স্ত্রী ঘরকন্না করবে, আর বছর ফিরতেই ফুটফুটে খুদে বেলালের জন্ম দিবে, এসব স্বপ্ন দেখতে দেখতে বেলাল মিয়ার দ্বীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।

বিকালের সময়টা বেলাল মসজিদে কাটিয়ে দেয় সাধারণত, কাজেই বিকাল হতেই সে রওনা দেয় সে পথে, যাবার পথে তার কওমি দীনের আরো ৫ জনকে সাথে নিয়ে যায়। আজকে জিকিরে বসে একটু খাস দিলে দোয়া করে বেলাল, যেন আজকে করিম ভাই তার প্রতি একটু সদয় হয়। তারপর সন্ধায় মসজিদ থেকে বের হয়ে বন্ধ গেট টপকিয়ে গ্রেটার রোড হয়ে গিয়ে হাজির হয় বর্ণালি সিনেমা হলের পাশের স্টলে, এখানে সাধারণত তাদের মীটিং হয়। গিয়ে সে দেখে, প্রায় সবাই চলে এসেছে। অপেক্ষায় বসে থাকে বেলাল, তার সময় আসলে সে জানায় এই সপ্তাহে সে কাজ বেশ এগিয়েছে, ৫ জনকে মোটামুটি সে নিশ্চিতভাবে দলে টানতে পারবে। শুনে করিম খুশি হয়ে যায়। ২ জনের বাবা নেই, খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে, সংসারে মা ছাড়া কেউ নেই একজনের, কিছু অর্থদিয়ে সাহায্য করলেই তাকে দলে টানা যাবে, অন্যজনার জন্যে আরেকটু কষ্ট করতে হবে, সে লেখাপড়ায় একটু বেশি দুর্বল, কাজেই পড়াশুনায় সাহায্য করলে কাজ উদ্ধার হবে, তবে এ ব্যাটা ষাড়ের মত তাগড়া, তার মত পেশি তাদের দলে খুব দরকার। এসব শুনে করিম খুব খুশি হয়। করিমের মুখে হাসি দেখে বেলাল বলে উঠে, ভাইমনি, আমার একটা আর্জি ছিল। এই যে রকিব, এই চ্যাংড়া কিন্তু আমাকে খুব নাজেহাল করছে, একে একটু সায়েস্তা না করলেই না। যত্রতত্র যার তার সামনে তাকে অপমান করে। আর সে লীগ করে, আমাদের নামে যা তা বলে বেড়ায়, এই সপ্তাহে ঐ বদমায়েশের জন্যে আমার ৩ টা মানুষ ছুটে গেছে। তাদের এমন কানপড়া দিল যে কি বলব!

এসব শুনে করিম নিজের দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে চিন্তা করে, দেখি, কি করা যায়। তার ব্যাপারে আসলেই কিছু করা দরকার। কিন্তু সামনাসামনি কিছু করা যাবে না। কোনভাবে যেন কেউ জানতে না পারে, আমরা কোনভাবে এসব কাজে জড়িত। তুমি মীটিং শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর। বেলাল বসে থাকে, ২ টা বন রুটি আর ২ টা কলা ধ্বংস করে বসে বসে, আমার বুদ্ধিতে শান দিতে থাকে। মীটিং শেষে করিম বলে, চল বেলাল, রিকশায় উঠ্, যেতে যেতে বলি। করিম বলে, এভাবে তুমি সবার সামনে এ ধরনের অভিযোগ করবা না না, সবাইকে তো আর বিশ্বাস করা যায় না। তোমারে গহরের সাথে জুটায় দিতাছি। সে এই ব্যাপারে কাবিল, এমন ভাবে কাম সারবে, ডান হাতের কাম বাম হাত ও জানতে পারবে না। এসব শুনে বেলালের চোখ ধ্বক ধ্বক করে জ্বলতে থাকে, আজকে সে হেনস্তা করবে রকিবের। বাইর করতেসি তোর মুক্তমনা চিন্তাভাবনা আর তোর রাজনীতি। উপশহরে এসে একটা বাড়িতে হাজির হয় তারা ২ জনে, একটা বাসার কড়া নাড়ে করিম, এখানে আগে আসে নাই বেলাল। একটা বনমানুষ দরজা খুলে দেয়। এই লোকটাকে তার খুব চেনা চেনা লাগে। তারপর মনে পড়ে, আরে এ তো সেই লক্ষীপুর মোড়ের বাজারের কসাই। কি নিপুণ হাতেই না মাংস কাটে। করিম এসে বুঝিয়ে দেয়, কি করতে হবে।

রাত বাজে সোয়া ১১টা, ১১ টার পরপর মেয়েদের হলের গেট বন্ধ করে দেয়, সারাদিন প্রেমের নামে বেলেল্লাপনা করার পর রকিব বাসায় ফেরে সোয়া ১১টার দিকে, ক্যাম্পাসের গেটের পানির ট্যাংকির পাশ দিয়ে হেটে যায়। এ স্থানটা বেশ নির্জন থাকে এ সময়ে, তারা পানির ট্যাংকির নিচে লুকিয়ে থাকে। এর মাঝে রকিব শিস দিতে দিতে এগিয়ে আসে, কাছে আসতেই বেলাল তাকে ডাকে, রকিব খুব নির্ভীক ছেলে, কোন পরোয়া না করে সাড়া দেয় সে, কাছে এসে বলে, আরে এ যে দেখি আমাদের ছাগলা দাড়ি বেলাল। কি ভাইজান, এইখানে আন্ধারে কি কর? বেলাল বলে উঠে, পিপিলীকার পাংখা গজায় মরিবার তরে, খুব বাড় বেরেছে তোমার। রকিব হাসি মুখেই বলে, আরে মস্করা করি, চেতো কেন? কিন্তু, অন্ধকারে রকিব দেখতে পায় না বেলালের খুদার্ত শার্দুলের চকচকে চোখ। কিছু বোঝার আগেই পেছন থেকে গহর এসে ধরে ফেলে রকিবকে। তারপর পানির ট্যাংকির নিচে প্রায় কোলে করে নিয়ে আসে, রকিবের চিৎকার কেউ শুনতেও পায় না, কেউ থাকলে না পাবে।

গহর রকিবকে পেড়ে ফালে ডানপাশে কাত করে, তারপর হাটু দিয়ে বুকের উপর চেপে বশে, আর বাম হাত দিয়ে মাথার চুল টেনে ধরে, আর বেলাল গরু জবাইয়ের ছুরি হাতে এগিয়ে হাসে, মুখে পিশাচের হাসি, চোখ জোড়া যেন ২টুকরা জ্বলন্ত হীরা। তার এক হুংকার দিয়ে বেলাল ছুরি চালায়, ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে, আর বেলাল সেই ফিনকি দেয়া রক্তের সাথে শ্বাসনালী দিয়ে বের হয়ে আসা ফোস ফোস শব্দ শুনে হা হা করে হেসে উঠে, আর বলে, কে হাসছে শেষ হাসি, কাফেরের বাচ্চা কাফের? তারপর রকিবের রক্ত হাতে মাখিয়ে নেয় বেলাল, বুকভরে নেয় সেই রক্তের গন্ধ, কেমন যেন নোনতা মিষ্টি একটা গন্ধে ভরে যায় চারদিক। তারপর ছটফট করতে থাকা রকিবের দেহটা নিষ্প্রান আর স্থির হয়ে যায় এক সময়ে। কিন্তু কসাই গহরের কাজ তো তখনো শেষ হয় নি, সে রকিবের হাত পা আলাদা করে ফেলে কেটে, তারপর বস্তায় ভরে, তারপর সেই দেহটা নিয়ে চিড়িয়াখানায় যায়। তারপর গিয়ে এক টুকরা করে বাঘের খাচায় করে ফেলে দেয়। কেউ যানতেও পারেনি আজ পর্যন্ত রকিবের কি হয়েছিল সে রাতে।

একজন অন্ধ মানুষ

অনেকদিন ধরে একটা বিষয় নিয়ে লিখতে চাচ্ছি, কিন্তু লেখতে পারতেছি না, এমন এক বিষয়ে আমার এই লেখাটা যা আমার মনে অনেকদিন ধরেই যন্ত্রনা দিয়ে যাচ্ছে, লিখে হয়ত এই যন্ত্রনা আরো ছড়াব বই আর কিছুই করতে পারবো না। যে কারনে অন্য বিষয় নিয়েও মন খুলে লিখতে পারছি না, কিছু লিখতে গেলেই এই যন্ত্রনা বের হবার পথ খুঁজে। এই লেখাটা কাউকে হেয় করার জন্যে নয়, নিতান্তই একজন মানুষের ঘটনা, সে যদি কোন দিন এই লেখাটা পড়ে, হয়ত আর জীবনে আমার সাথে কথাই বলবে না, কিন্তু, প্রায় ২০ বছর ধরে আমি এই বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি, আর আজকে লিখতে বসেছি সেই ওজন কিছুটা হলেও হালকা করার জন্যে। এই চেষ্টা নিতান্তই স্বার্থপর, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ঘটনা আমার এক পারিবারিক ভাবে পরিচিত ব্যক্তিকে নিয়ে। স্বভাবতই নাম গুলো কাল্পনিক, যাতে করে কেউ হুট করে চিনে বের করতে না পারেন। আর কথা না বাড়িয়ে আসেন তার কথা শুনি। আমি যতটুকু জানি, ততটুকুই বলার চেষ্টা করব।তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি চোখে দেখেও অন্ধ, নিজে না দেখলে হয়ত বিশ্বাস করতাম না, মানুষ এমন সব বিভ্রান্ত ধারনা নিয়ে চলে।

সালাম এর সংসারে মা আর বোন ছাড়া কেউ নেই। তখন ব্রিটিশ শাসন, তার বয়স যখন ৩ বছর, তখন তার বাবা মারা যান যক্ষা রোগে, সে তখনো কিছুই বুঝতো না, তার মাকে যৌবনে বিধবা হয়ে তার ভাসুর আর শ্বশুরের জ্বালায় গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়, সে গল্প না হয় আরেকদিন বলা যাবে। যাক, সালাম আস্তে আস্তে বড় হয়, তার মা তখন তখন ভাইয়ের বাসায় থাকেন ২ ছেলেমেয়ে কে নিয়ে। স্বামীর তাকে দিয়ে যাওয়া কিছু জমি ছাড়া আর কিছুই নেই, কিন্তু তাতে দমবার পাত্রী নন তিনি। তার আরেক ভাই ঢাকা শহরে থাকেন জেনেও সেখানে জান নি, যদি তার ছোট ২ ছেলেমেয়ে গাড়ি চাপা পরে মারা যায়। এভাবে দিন চলতে থাকে, সালামের বয়স ৫ হয়। সে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। ভাই বোন দুজনেই খুব মেধাবি, কাজেই তার মাকে কোন পয়সা দিতে হয় না স্কুলে। বছর ঘুরতেই তার মেধার কথা সবাই জেনে যায়। স্কুলের শিক্ষকরা তাকে একটু যত্ন নিয়ে পড়াতে থাকে। এভাবে সে আস্তে আস্তে ৭ পেরোয়, তখন তার মা তাকে বলে, যা বাবা, ৫ওয়াক্ত নামায পড়তে হবে এখন থেকে, আর জুম্মার নামাযটা মসজিদে গিয়ে পড়বি। কিন্তু সালাম খুব ভয় পায়, আর তার নাকি লজ্জাও লাগে। সে কোন ভাবেই রাজি হয় না, গো ধরে থাকে, কিন্তু তার মা তাকে নানা ভাবে ফুসলিয়ে ফাস্লিয়ে তাকে মসজিদে যাবার তাগাদা দিতে থাকে। শেষমেষ তাঁর মা তাকে রাজী করায় যে, এক্কেবারে শেষে যাবে মসজিদে, সবার শেষে গিয়ে দাঁড়াবে, ফরয তো মাত্র ২ রাকাত, নামায শেষ হলেই দৌড় দিয়ে চলে আসবে। সালাম রাজী হয়ে যায়, হাজার হলেও মা ছাড়া তার আর কেউ নেই।

এভাবে বড় হতে থাকে সালাম, একদিন বাজার করতে যায় সে, মা বলে দিয়েছে, মুরগি কিনে আনতে, সে ভুলে যাবে বলে প্রথমে গিয়ে মুরগি কিনে, তারপর অন্যান্য বাজার করে বাসায়া সে, তারপর মা ব্যাগ হাতে নিয়ে বলে, কিরে মুরগি কই? সে বলে, কেন ব্যাগের নিচে, শুনে তো মা এক চিৎকার দিয়ে উঠেন, বলেন, করেছিস কি তুই। মুরগি বের করে দেখেন দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে মুরগি। মার তো একটাও মাটিতে পড়েনা। এর মাঝে কয়েকবার তিনি চেষ্টা করেছেন নিজের স্বামীর ভিটাতে ফেরত যেতে, এর মাঝে খবর আসে, তার শ্বশুর মারা গেছেন, কাজেই তার ভাসুরেরা এখন আর অতটা ঝামেলা করবেন না, তিনি চাইলে ফেরত আসতে পারেন। কাজেই আশায় বুক বেঁধে তিনি ছেলেমেয়ে কে নিয়ে ফেরত আসেন স্বামীর ভিটায়, এখানে এসে ছেলে মেয়েকে আবার স্কুলে পাঠান তিনি, তার স্বামীর দিকের আত্মীয়স্বজনেরা নানা ভাবে জ্বালা যন্ত্রনা করতে থাকেন, তারপরেও তিনি মুখ বুজে দিন চালিয়ে যেতে থাকেন। এর মাঝে তার ছেলেমেয়ের মেধার খবর আবারো ছড়িয়ে পড়ে। ২ জনেই যার যার শ্রেনীতে প্রথম হয়, না জানার কোন কারন নেই। তখন বসন্ত কাল ছিল, তার বাড়ির পিছনে বিশাল কাঁঠাল গাছে বিরাট এক মৌমাছির চাঁক বাসা বেঁধেছে, তিনি এক প্রতিবেশিকে দিয়ে সেই চাঁক ভাঙ্গান, কিন্তু সেই লোকটা খুব অপটু ভাবে কাজটা করে, গাছের নিচে কিছুটা মধু পড়ে থাকে। ধোঁইয়া দিয়ে তাড়ানো সব মৌমাছি সেই মধুর গন্ধে ফিরে আসে, তারপর ক্রোধে অন্ধ হয়ে ঘুরতে থাকে প্রতিশোধের লোভে। পরদিন সকালে সালাম আর তার বোন হাত মুখ ধুতে বের হয়ে আসে, এসে পড়ে মৌমাছির খপ্পরে, ২ জন তাড়া খেয়ে ২ দিকে দৌড়ায়, কিন্তু তার বোন কিভাবে যেন কাছে পুকুর পেয়ে যায়, সে গিয়ে এক লাফে পুকুরে নেমে যায়। কিছু বেচারা সালামের ভাগ্যটা এত ভালো ছিল না, তাকে তারা করতে করতে মৌমাছি ধরে ফেলে, তারপর ফুটাতে থাকে অসংখ্য হুল। সারা গা ফুলে যায় সালামের, ৩জন লোক মিলে তার গা থেকে হুল তুলতে হয় সে যাত্রায়। একমাস বিছানায় কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠে সালাম।

এভাবে মেট্রিক পরীক্ষায় সময় আসে, সালাম এত নরম সরম মানুষ যে, কেউ তার জীববিদ্যার ব্যবহারিক খাতা চাইলে সে না করতে পারে না, তার সহপাঠীরা তার খাতা নিয়ে দেখে দেখে ছবি আকে, এমন করতে করতে কেউ একজন খাতা মেরে দেয়। কিন্তু পরীক্ষায় তাতে সালামের কোন সমস্যা হয় না। সে যেন বিকারহীন, খাতা হারানোর জন্যে তার মায়ের কাছে থেকে মাঝারী মাপের মার খাওয়া লাগে, কিন্তু তার শিক্ষক বলেছেম আরে সালাম তোর খাতা তো আমাদের সবার মুখস্ত, তোর খাতা লাগবে না। আর এদিকে যে চুরি করেছে, সেও ব্যবহার করতে পারে না, কারন সবাই চিনে সেই খাতা। মেট্রিকে খুব ভালো ফল করায় ভালো কলেজে বিনা খরচে পড়ার সৌভাগ্য হয়। সে গনিতে আর বিজ্ঞানে খুবই ভালো, কাজেই কলেজেও অনেক সুনাম তার। জীবনে সে অংকে ৯৮ এর নিচে পায়নি। তখন পাকিস্তান আমল, বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে কেউ পড়তে চায় না, কিন্তু তার খুব শখ সে প্রকৌশলী হবে, তাই সে ভর্তি হয় ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি তে (আগে এর নাম ছিল আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ১৯৬২ তে হয় ইপুয়েট, তারপর ১৯৭১ এ আবার নাম পালটে হয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি)।

ঢাকায় এসে থাকে সালাম, তখন তার মা আর বোন থাকে ময়মনসিংহ শহরে, কারন সে পড়ে ময়মনসিংহ মেডিকেলে। নানা বাধা বিগ্রহ পার করে অনেক কষ্টে তার মা তাদের এপর্যন্ত নিয়ে আসতে সক্ষম হন। হলে থাকতে হয়, কাজেই এটা তার জন্যে পুরাই নতুন ভুবন। এর মাঝে সে কিনা খপ্পরে পড়ে তাব্লিগ জামাতি দলের হাতে। যে কিনা মসজিদে যেতে ভয় লজ্জা পেত, সে সার্ট প্যান্ট ছেড়ে পায়জামা পাঞ্জামি পড়তে শুরু করে। মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে যেতে থাকে সালাম। এর মাঝে দেশে যুদ্ধ লেগে যায়, সে গ্রামে চলে আসে, চারিদিকে গন্ডগোল, জানের ভয়ে লুকিয়ে থাকে গ্রামে। এর মাঝে তার দাঁড়িও গজায় একটা। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে সে আবার ঢাকায় ফিরে আসে, তার ১ বছর পর সে পাশ করে বের হয়। চোখে নানা স্বপ্ন, দেশ গড়তে হবে, দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। পাশ করায় আগেই চাকরির ডাক পেয়ে যায়। সে যোগ দেয় বিএডিসিতে। এখানে এসে এক্কেবারে খাস তাব্লিগি বসের পাল্লায় পড়ে সালাম। চোখ বন্ধ করে কাজ করে যেতে থাকে সালাম। সে বুঝতেও পারে না, আস্তে আস্তে তার মগজ ধোলাই হয়ে যাচ্ছে এই সব মোল্লাদের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে। তার এই তাব্লিগি দলের প্ররোচনায় বিয়েও করে ফেলে সালাম। মেয়ের বাবা তাব্লিগি দলের খুব শ্রদ্ধেয় নেতা, মোটামুটি দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে কাকরাইল মসজিদে। বিয়ের পর শ্বশুরের কথায় উঠতে বসতে থাকে সালাম। তারপর শুরু হয় চিল্লায় যাওয়া। সালাম বলে, কাজ ফেলে আমি যাব কিভাবে? শ্বশুর হেসে বলেন, আরে, তোমার বস তো আমার বন্ধু মানুষ, তাকে বলে দিব, কোন ব্যাপারই না।

সেই যে শুরু হল, ধর্মের নেশায় অন্ধ হয়ে যায় সালাম। অফিসের কাজ উচ্ছন্নে যেতে থাকে, কেউ যদি কাজ ফেলে ৪০ দিন মসজিদে বসে থাকে, তাহলে কাজ হবে কিভাবে? আর কোন জবাবদিহিতাও নাই, কারন তার বস, তার সহকর্মীরাও সবাই তো তার সহযাত্রী, তারাও কোথাও না কোথাও চিল্লায় ব্যস্ত। কিসের দেশ গঠন আর কিসের দেশ সেবা। আস্তে আস্তে স্ত্রীকে নিয়েও যাওয়া শুরু করে সালাম চিল্লায়। তার মা বোন নানা ভাবে তাকে বুঝাতে চায়, ধর্ম পালন করতে গিয়ে ফ্যানাটিক হয়ে যাবার তো কিছু নাই। কিন্তু এসব কথা শুনতে সালামের তো আর ভালো লাগে না, তাই সে আস্তে আস্তে মা বোনের থেকেও দূরে সরে আসে। সংসার, চাকরি ফেলে কিভাবে সে এসব করে তা নিয়ে তার মা বোন প্রশ্ন করলে সে বলে, আল্লাহ থাকতে চিন্তা কি? উনি সব চালায় নেন। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে যায় তার একান্ত কাছের এই ২ মানুষ। তারাও আস্তে আস্তে বলা বন্ধ করে দেয়। তারা ভাবেন, বোধহয় বাচ্চা কাচ্চা হলে এসব বন্ধ হবে, কিন্তু কিসের কি, সালামের ঘর উজ্জ্বল করে আসে একটি পুত্র সন্তান। নাতিকে নিয়ে দাদীর কত স্বপ্ন, কিন্তু, সেই নাতীকে দেখাতেও নিয়ে আসে না সালাম। কারন তার নিজেরই সময় নেই, সে চিল্লা দিতে গেছে, বাচ্চা হবার ১০ দিন পর ফিরে আসে সালাম। একপর্যায়ে তার মা আর থাকতে না পেরে নিজে এসে হাজির হয় নিজের ছেলের ঘরে নাতি দেখতে। যদিও তার মেয়ের ঘরে একটা নাতি হয়েছে। কিন্তু তারপরেও দাদী হবার অনুভূতি যেন আলাদা।

বাচ্চা হওয়ায় স্ত্রীকে নিয়ে দৌড়ানো স্থগিত করতে বাধ্য হয় সালাম, কিন্তু বছরে ৩-৪ বার করে সে চিল্লায় যেতে থাকে, আর কাকরাইল মসজিদ ও আছেই, নেশাগ্রস্তের মত সেখানে গিয়ে হাজির হয় সে, এর মাঝে তার পদোন্নতি হয় সেখানে। তাকে এখন নানা কাজের দায়িত্ব দেওয়া হুয়েছে। বিদেশ থেকে যারা আসেন তাবলিগ করতে, তাদের দেখভাল করে সালাম। আর সৎ হিসাবেও তার অনেক সুনাম। এদিকে অফিসের কাজ তো লাটে উঠে বসে আছে। এভাবে ৪-৫ মাস চিল্লায় থাকলে অফিসের কাজ হবে কিভাবে? কিন্তু, ঐযে, কোণ জবাবদিহিতা নেই, ফলে ফাইল আটকে থাকে, এদিকে ঘুষ খায় না বলে অফিসেও তার সুনামের পাশাপাশি দুর্নাম ও হতে থাকে। ঘুষ খাবারোতো একটা লাইন ঘাট আছে, মাঝে একজন ঘুষ না খেলে মহা বিপদ, তার টেবিলে ফাইল আসলেই তার অনুপস্থিতিতে এমনিতেই বসে থাকে, তারপর সে ফিরে এসে দেখে নানা রকমের গোজামিল দিয়ে ভরা ফাইলগুলো। এসবের মাঝে আবার তার আরেকটা কন্যা সন্তানো জন্ম হয়, তার বোন তাকে বলে, ২ টা হয়ে গেছে, এবার বাচ্চাকাচ্চা নেয়া বন্ধ করা উচিত। এসব শুনে যেন সালামের মাথা গরম হয়ে উঠে। আল্লাহর দেখানো রাস্তায় বাধা দেবার সে কে? তার ভাগ্যে যদি আরো সন্তান আসার থাকে আসবে। এভাবে আরো একটা মেয়ের জন্ম হয়। এর মাঝে তার অফিসেও পদোন্নতি হয়, যেটা ৫ বছরে হবার কথা সেটা হতে ১০ বছর লাগে, লাগবেই তো, কারন অই ১০ বছরের ৫ বছর তো সে কাটিয়েছে অফিসের বাইরে। তাবলিগের নামে সে নানা দেশেও যায়, তার তাবলিগ জামাতের লোকজনের সাথে।

এদিকে তার মার মায়ের কত স্বপ্ন, তার ছেলের ঘরের নাতিপুতি বাপের মত পড়াশুনা করে বড় বড় পদে আসীন হবে, কিন্তু তার মায়ের আশায় ছাই ঢেলে দেয় সালাম। সে তার বড় ছেলে এবং মেয়েকে ভর্তি করে দেয় মাদ্রাসায়। মাদ্রাসায় কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সালাম তখন এতটাই ধর্মান্ধ হয়ে গেছে যে তার ছেলে কে হাফেজ বানাতে উম্মত্ত হয়ে যায়। ছেলে থাকে চাঁদপুরের এক মাদ্রাসায়, আর মেয়ে কে মা গৃহ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে থাকে। সালামের বউ হাতে গোনা কয়েকটা জিনিষ ভালো পারে, অন্যের দুর্নাম করা আর দোষ ধরা, আর রান্না করতে। অসাধারন তার রান্নার হাত। যাবতীয় খান্দানি রান্নায় তার অপুর্ব গুনাবলীর প্রকাশ পায়।

আমেরিকা আসে সালাম তাবলিগের কাজে, ঘরে তার স্ত্রী আবারো সন্তান সম্ভবা, আসছে তার চতুর্থ সন্তান, ছেলে হওয়ার এসে হাজির হয় সালাম। তার বোন এবারো তাকে খুব বকাঝকা করে, কারন বাচ্চার অবস্থানটা ছিল খুব সঙ্কটময়, কিন্তু,এ সব চিন্তা করার সময় তো সালামের নাই। অপারেশন করে জন্ম হয় তার চতুর্থ সন্তান, একটি ফুটফুটে ছেলে। এর সব ভ্যাজালের মাঝে সালামকে বদলি করা হয় চট্টগ্রামে। কালুরঘাটে অফিসে যায় সালাম। যাওয়ার পরের মাসেই আবার তাবলিগের কাজে বিদেশের পথে পাড়ি জমায় সালাম। ঘরে তার চারটে বাচ্চা, তার কোন বিকার নেই, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, আল্লাহ আছে, তিনি দেখার মালিক, তিনিই দেখে রাখবেন। কালুর ঘাটে গিয়ে সালামের সাদা রঙের চাকুরি জীবনে লেগে যায় কালো কালির ছিটা। এখানে নানা পদের মেশিনারি আমদানি হয়, তার দেখভাল করতে হয় সালামকে। সেরকমই এক চালানের মাঝে গড়বড় বের হয়, ৩ মাসের জন্যে বেতন আটকে যায় তার। এমনিতে সৎ মানুষ, আলগা কামাই নেই, বেতন আটকে যাওয়ায় ভীষন বিপদে পড়ে যায় সালাম। কাজেই বাধ্য হয়ে তার বোনের সাথে দেখা করতে হয়, কিছু টাকা পয়সা ধার করে সংসার চালাতে থাকে সালাম। তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়, কিন্তু সততার গুনে সে বেকসুর প্রমাণিত হয়।

কিন্তু তাকে আবারো বদলি করা হয়, এবারের গন্তব্য চাঁদপুর, এখানে আগে যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন, তার ঘুষের ক্ষিদা এতই বেশি যে, পারলে সে কুমিরের মত নিজের বাচ্চাই খেয়ে ফেলে। ফলে অফিসের সুনাম ফিরিয়ে আনতে বড়কর্তাদের সালামের মত সহজ সরল ধর্মান্ধ মানুষ দরকার, কাজেই সালাম গিয়ে যোগ দেয় সেখানে। কিন্তু আগের ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পতন এতটাই গভীর ছিল যে, সে এখান থেকে চলে যেতে চাইলেন না, তার কতজনের সাথে ব্যবসায়িক আতাঁত আছে, সেগুলো ছেড়ে নতুন স্থানে গিয়ে আবার নতুন করে পথ ঘাট চেনার সময় তার নেই, কাজেই সে লোক মারফত খবর পাঠায় সালামের কাছে যে, তাড়াতাড়ি এখানে থেকে সেচ্ছায় বদলি হয়ে চলে যেতে নাহলে তার জীবনের আশঙ্কা আছে। এসবে ভয় পাবার লোক সালাম নয়, সে একজন কেই ভয় পায়, তার আল্লাহ, তার সৃষ্টিকর্তা।

কিন্তু এখানে হিসাবে ভুল করে ফেলে সালাম। এক রাতে তার ঘরে ঢুকে পড়ে আততায়ী, এসে তাকে ছুরিকাহাত করে, ভাগ্যগুনে ছুরিটা ঢুকার সময় তার ডানহাতে আঘাত করে, তার ডানহাতের রগ (নার্ভ) ক্ষত হয় এবং একটা শিরা কেটে যায়, আর বুকের আঘাত পিছলে যায়, ২-৩ বার আঘাত করার পর আততায়ী পালিয়ে যায়। এতে করে সে খুব ভয় পেয়ে যায়। তারপর রক্তক্ষরনের জন্যে জ্ঞান হারায়, তারপর তার জ্ঞান ফিরে একটা ক্লিনিকে, তারপর সেখানে একটু সুস্থির হলে তাকে তার বোন নিয়ে যায় রাজশাহী। কারন তিনি তখন আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন। আর চাঁদপুরে তার নার্ভ বা শিরা কোনো টারই চিকিৎসা হবে না। ২ দিনের মাথায় সালাম এসে হাজির হয় আমাদের পাশের বাসায়। তারপরে ২ ধাপে তার অপারেশন করা হয়, নার্ভ কেটে গেলে আর তা পুরোপুরি ঠিক হয় না, ভাগ্যক্রমে তার নার্ভের ক্ষত একটু কম হওয়ায় তার হাতের শক্তি একটু কমে যায়, কিন্তু শিরাটা ঠিকঠাক মতই জোড়া দেওয়া যায়।

সালামের বড় ছেলে আমার এক বছরের বড়, আমার সাথে বেশ বন্ধুত্বই হল, তার ২ মেয়ে তো ঘোমটার আড়ালে, ফলে আমি তাদের দেখিনি কখনো। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ি, আর সালামের ছেলে পুরো দস্তর হাফেজ। কথা প্রসঙ্গে আমি একদিন সালামকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার যে এতগুলা ছেলেপেলে, বড় হয়ে তার কি করবে? সে খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল, কেন, আল্লাহ যা বানাবে, তাই হবে। আমি বললাম, কিছু হবার জন্যে তো সেই পথে ঘাটে কাজ করতে হবে, পড়াশুনা করতে হবে, যেমন আমি ডাক্তার হতে চাই, এজন্যে আমি স্কুলে পড়ছি, এরপর মেট্রিক ইন্টার দিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হব। আপনার বড় ২ ছেলে মেয়েকে যেভাবে পড়াচ্ছেন, তাতে তারা বড় হয়ে কি করবে? আমার ইচড়ে পাঁকা প্রশ্ন শুনে সালাম ডানে বাঁইয়ে মাথা ঝাকায় আর বলে, কেন আল্লাহর পথে চলবে, তিনি উনাদের জীবিকার ব্যবস্থা করবেন। আমি বললাম, আপনার কথাটা শুনে কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে রুজি করার মত শোনাচ্ছে। ধর্মেই না এর নিষেধ আছে? আর আমি তো তখন পুরাই ফর্মে, আরো জিজ্ঞেস করে ফেললাম, আপনার যে ৪ জন বাচ্চা, সবখানে প্রচার করা হচ্ছে, ছেলে হোক বা মেয়ে, ২ টি সন্তানই যথেষ্ট, আপনে কি বুঝে ৪ জন বাচ্চা নিলেন? সে খুব হেসে বলে, তুমি বাচ্চা মানুষ, এসব বুঝবে না, বড় হলেই বুঝবে। আমিও হেসে বললাম, বুঝিয়ে দিলেই না বুঝবো। তার স্ত্রী পাশ থেকে বলে উঠল, আমার ৪ বাচ্চা, কু্রআনের হাফেজ হবে, তারপর ৪ জোড়া হাত আমার কবরের পাশে হাত তুলে দোয়া করবে, আমাদের বেহেশত নসিব হলে, কার জন্যে হবে?

যাক, আমার এই প্রশ্নবানের ফলাফল খুবই ভয়ংকর ছিল, বাসায় বাবা মা ফেরার পর যথারীতি সালাম এসে আমার বাবার কাছে সকল কথোপকথনের বৃত্তান্ত শুনিয়ে গেলেন, রাতে আমাকে বেধরক মার খেতে হল বেয়াড়া প্রশ্নের জন্যে। আমার বাবা রাগ ছিল একটাই, আরেকজনের বাসায় গিয়ে তার আত্মীয়ের সাথে এই বাগাড়ম্বর কেন করেছি? যাক, পরে বাবা নিজেও খুব কষ্ট পেয়েছেন, আমাকে আমাকে পেদানি দেবার জন্যে, আসলে বিচার শুনতে হত প্রায়ই তাকে, কাজেই কিছু শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। আর ফলাফল টাও তেমনই ভয়ানক হত। আসল কথা হল, তখন আমার ইঁচড়ে পাকামি তিনি একদম পছন্দ করতেন না। আমাকে বয়সে ছোট দেখে মানসিক ভাবেও ছোট হিসাবেই গণ্য করতেন, আর আমার বাবা একা নন, সবাই এভাবেই দেখতেন আমাকে। যাক, এরপরে আমার পাশের বাসায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল, যতদিন উনারা ছিলেন, আমার জন্যে ঐ বাসা ছিল নিষিদ্ধ স্থান। চিকিৎসার পর সালাম ঢাকায় বদলি হয়ে যায়, এবারে সে শ্বশুর বাড়ির পাশে একখানা জায়গায় বাড়ি করে, ছোট্ট একখানা বাসা, শোবার একটাই ঘর। এদিকে তার মা একা একা ময়মনসিংহে থাকেন, তার মেয়ে তাকে দেখতে আসে মাঝে মাঝে, তার চাকুরি এখন বরিশালে। তিনি ও মাঝে মাঝে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে মাসখানেক থাকেন। কিন্তু ছেলের বাড়িতেও তিনি যান না, ছেলেও তাকে দেখতে আসে না, আসলেও একা আসে, সকালে এসে বিকালে চলে যায়।

১৯৯২ এ আমরা ঢাকা চলে আসি। আমি রেসিডেন্সিয়ালে ভর্তি হই, আর আমার ভাই বুয়েটে। সেখানে এসে কয়েকবার সালামের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। এর মাঝে খবর পেলাম, তার স্ত্রী আবার সন্তান সম্ভবা, আর তার ৪ ছেলেমেয়েই এখন মাদ্রাসায় যায়, তবে মেজ মেয়েকে তিনি বাসায় মেট্রিক পরীক্ষার বই পুস্তক দিয়ে পড়িয়ে পরীক্ষা দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন। তার বড় ছেলে মাদ্রাসায় কি এক পরীক্ষা দিয়ে হাফেজ হয় হয় অবস্থা। যেহেতু আমরা একা থাকি, কাজেই সালাম আসতো মাঝে মাঝে আমাদের দেখতে। মাঝে মাঝে সপরিবারে আসত, তবে এর মাঝে কয়েকবার তাকে আমি অংকের সমস্যা দেখিয়েছি, যে কোন সমস্যা নিয়ে তার কাছে গেলেই যেন বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ জ্বলে উঠত, অংক দেখেই বলে দিত, এর উত্তর এত। আমি মনে মনে বলতাম আহারে, কি জিনিয়াস একটা লোক। এর পরেও কয়েকবার পড়াশুনা বুঝে নিয়েছি তার কাছ থেকে, এত সুন্দর করে বুঝাতে পারে সে, মনে হয় যেন, এই সালাম আর সেই সালাম এক মানুষ নয়।

সালামের মা সালামকে বলে একবার, তোর ছোট ছেলেটাকে আমার কাছে দে, তোর সংসারে ৫ টা বাচ্চা, সবার যত্ন নিতে পারিস না ঠিকমত, এর চেয়ে আমি ছোট ছেলেটাকে স্কুলে দেই, আমার সাথেই থাকুক, ওর সকল খরচাপাতি নাহয় আমি দিব। তোর একটা ছেলেকে অন্তত স্কুলে পড়তে দে। কিন্তু কিসের কি, পুরা কিসিমের ঝগড়া হয়ে যায় মা ছেলেতে। ভাগ্যিস সাথে তার স্ত্রী ছিল না, থাকলে মনে হয় সে শাশুড়ির গলাই টিপে ধরত। তবে এমন প্রস্তাব দেবার জন্যে নানান কটু কথা শুনতে হয় তার বৃদ্ধা মাকে। সে এই বলে বের হয়ে আসে, আমাদের দেখার জন্যে উপরওয়ালা আছে, আপনার চিন্তা না করলেও চলবে। যার জন্যে এত কষ্ট করে তিল তিল করে মানুষ করল, সেই ছেলেই কিনা আজ মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যায়।

এর মাঝে সালামের অফিসে ছাটাই শুরু হয়, খবর আসে, বিএডিসি বলে কিছু থাকবে না। এরমাঝেও সালামকে কখনো একটু চিন্তিত হতে দেখিনি, পুরাই বিকারহীন একজন মানুষ। সবকিছুতেই উপর ওয়ালার ইচ্ছায়ই সব কিছু হবে, আমার কিছু করার নাই রকমের একটা ভাব। ব্যাপক হারে ছাঁটাই শুরু হয়, অনেকেই ঝরে পরে যায়, এতকিছুর পরেও সালামের চাকরি থাকে, তবে তার অফিসের অবস্থা খুবই করুন হয়ে যায়। কিন্তু এর মাঝেও তার তাব্লিগি চলতে থাকে পুরা দমে। আরো শুনি সে আর তার স্ত্রী হজ্জে যাচ্ছে, সাথে যাবে তার শশুর বাড়ির সকলে। আমি অবাক হয়ে বললাম, তা আপনি আপনার মাকে নিয়ে যাবেন না? সে নির্বিকার ভাবে বলল, না, আমরা তাব্লিগি দলে যাচ্ছি তো, এখানে থেকে হজ্জে যাবো, তারপর সেখানে থেকে লন্ডনে যাবো, তারপর আরো কয়েক স্থানে যাবার ইচ্ছা আছে, আল্লাহ যা রাখে কপালে। আমি আর আমার বড় ভাই ব্যাপক হারে গালাগালি করলাম সালামকে।

সালাম হজ্জে চলে যায়, তখন ১৯৯৭ সাল, আমার এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ, কোরবানির ঈদের ছুটিতে দেশের বাড়ি গিয়েছিলাম, ফিরে এসেছি, এক সপ্তাহ পড়ে ব্যবহারিক পরীক্ষা, এর মাঝে খবর আসল, সালামের বড় মেয়েকে কে যেন পিস্তল দেখিয়ে তুলে নিয়ে গেছে বাসা থেকে। তার বোন তখন বদলি হয়ে ঢাকায় চলে এসেছে। কিন্তু সালাম তার ছেলেমেয়েকে সেখানে রেখে যায় নি, রেখে গেছে তাদের এক তাব্লিগি দলের বাসায়। সেখান থেকে এ ঘটনা ঘটেছে। পাড়ার মাস্তান এসে বলে তাকে তুলে নিয়ে গেছে। আমরা তো শুনে থ'। হাজার হলেও এরা পুরাই পর্দানশীল পরিবার, পাড়ার মাস্তান এই মেয়েকে দেখলই বা কিভাবে আর খোঁজ পেল কিভাবে যে কোথায় আছে? সালামের বোনের জামাইয়ের পুলিশি বন্ধুবান্ধব যারা ছিল, তাদের সকল সুতাটানাটানি শুরু হল, পাড়ার মাস্তানের বাবা মা কে পুলিশ ধরে আনল, সে নাকি পাড়ার মদ বিক্রেতা। আরো মজার খবর বের হল যে, তাদের ভাষ্যমতে, তার ছেলে তার প্রেমিকাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এমন কিছু শুনলেই বিশ্বাস করা যায় নাকি? কিন্তু ছেলের বাবা মা ছবি বের করে দেখায়, অর্থাৎ এই বোরখা ওয়ালি নিনজা বোরখার নিচে কি খেমটা নাচটাই না নেচেছে। আরো বের হল, সালামের মেয়ের ডায়রি। সেখানে বেশ নাটকিয় ভাবে এই মেয়ে লিখেছে তার বিভিন্ন মনোবাসনা।

২দিন পরে পুলিশ সালামের মেয়েকে উদ্ধার করে আনে এক গ্রাম থেকে। এর মাঝে সালামের দুলাভাই তো রাগে খালি গর্জন করে যাচ্ছে, আর কিছুই তো করার নেই তার। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি সালামের কাছে খবর পাঠান, যেন তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সাথে যোগাযোগ করেন। প্রায় আরো ২ দিন পর সালাম মক্কা থেকে ফোন করে, তারপর জানতে পারে তার গুনবতী কন্যার গুনাবলীর বিস্তারিত বর্ননা। এরপর সে মক্কা থেকেই সরাসরি দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয় শুধু তার স্ত্রীকে নিয়ে। মজার বিষয় হল, তার বাসায় কোন টিভি ছিল না, ছিলনা কোন বেয়াড়া গল্পের বই, ছিল শুধুই একনিষ্ঠ ধর্ম বিশ্বাস। ফিরে এসে সে এলাকা ত্যাগ করে অন্য এক এলাকায় বাসা নেয়, তারপর তাড়াতাড়ি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয় এক বিদেশগামী ছেলের সাথে। যতদুর জানি সেই মেয়ে এখন বছর ঘুরতেই একজন করে মানব শিশুর জন্ম দিয়ে যাচ্ছে, কারন তার বিয়েও হয়েছে তাব্লিগি দলের এক অনুসারীর সাথে।

সালাম হজ্জ থেকে ফিরে আসলে তার মা তাকে ডেকে পাঠায়, তার ডাকে সাড়া দিয়ে সে আর তার স্ত্রী হাজির হয়। বেচারি খুব দুঃখের সাথেই বলেন, তোরা এমন একটা কাজ করলি, জানতি যখন তোর মেয়ে পাড়ার এক মাস্তানের সাথে প্রেমে পড়েছে, সেটা জানিয়ে তোর মেয়েকে আমার কাছে রেখে যেতে পারতি, আমার জান থাকতে ওকে কেউ তুলে নিয়ে যেতে পারত না। এর জবাবে বারুদের মত জ্বলে উঠে স্বামী স্ত্রী, যা তা বলে বকাবকি করে বৃদ্ধা মাকে, এক পর্যায়ে তার স্ত্রী বলেই ফেলে, আমার মেয়েকে দরকার পড়লে আমি কেটে পানিতে ভাসায় দিব, তাতে আপনের কি? আমাদের যেখানে যেভাবে ইচ্ছা, সেখানে সেভাবে আমাদের মেয়েকে রাখবো, তাতে আপনার কি? এই শুনে সালামের বৃদ্ধা মাতা একেবারেই চুপ মেরে যান, পরে জানতে পেরেছিলাম, তিনি প্রায় ৪ দিন দানাপানি স্পর্শ করেন নি, তার মেয়ে অনেক বুঝিয়ে তার মন নরম করিয়েছিলেন, কিন্তু তারপরে আর তিনি কখনো তার ছেলেকে বা ছেলের বউকে উপদেশ দিতে যান নি। আমার আমরা জানতে পারার পর আমার বাবা কে জানিয়ে দিয়েছিলাম তিনি যেন আমাদের বাসায় না আসেন, আসলে দাড়ি কেটে মাথা মুড়িয়ে ছেড়ে দিব আমরা ২ ভাই মিলে।

এর মাঝে সালাম কয়েকটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করার চেষ্টা করে বিকালে। কিন্তু দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করতে করতে তার গায়ে যেন জং ধরে গেছে, বেসরকারি চাকরির ধকল যেন তার সহ্য হয় না। আবার অন্যদিকে তার সরকারী চাকরিও এখন তখন যায় যায়। কিন্তু এত কিছুর পরেও তার কাকরাইল মসজিদের কাজকর্ম একই গতিতে চলতে থাকে, বয়সের কারনে চিল্লার পরিমান কমতে থাকে। এর মাঝে তার বড় ছেলে হাফেজ হয়ে গেছে, আর ছোট ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে, সেজ মেয়েও মাদ্রাসায় পড়ে আর একদম ছোট্ট (পঞ্চম) মেয়ে তখনো কোথাও ভর্তি হবার বয়স হয়নি। ভাগ্যিস পঞ্চম মেয়ে হবার সময় তার স্ত্রীর জরায়ুতে টিউমার দেখা যায়, ফলে বাচ্চা হবার পরেই তার জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়, নাহলে দেখা যেত, আমার মেয়ের পাশে উনার বাচ্চাও দৌড়ে বের হচ্ছে, যে দেশে জনসংখ্যা একটি জাতীয় সমস্যা, সে দেশে একজন শিক্ষিত মানুষ বছর ফিরতেই নতুন মুখ আনে কি করে আমি এখনো বুঝে পাই না। অবশ্য অন্যের জীবন নিয়ে এভাবে মন্তব্য করা ঠিক না, কিন্তু কিভাবে যেন সকলের অপছন্দের কাজ গুলি আমি ঘটা করে করে থাকি।

সালাম এখনো বিএডিসিতে আছে, সততার নিদর্শন স্বরূপ তার চাকরি যায় নি, তবে অবসর নেবার সময় চলে এসেছে, তার বর ছেলে বিয়ে করেছে, সেই তাব্লিগি নেটওয়ার্কেই। আমি দিন গুনছি, কোন একদিন শুনব, সালামের পুত্রবধু সন্তান সম্ভবা, তারপর সেই পুরানো চক্র আবার শুরু হবে। তবে, এখন সালাম মোটামুটি ঘরকূনো হয়ে গেছে, বয়স তো আর কম হয় নি, আগের মত দৌড়াতে পারে না। তার মা এখনো বেঁচে আছেন, সোজা হয়ে দাড়াতে পারেন না। স্মৃতি শক্তির অবস্থাও খুব করুন। আমাকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন, তবে আমি বিয়ে করেছি শুনে খুব অবাক হয়েছেন। আমার বাচ্চাও আছে শুনে আকাশ থেকে পড়েছেন। তিনি এখনো একা থাকতেই পছন্দ করেন, বছরের অর্ধেক সময় থাকেন ময়মনসিংহ আর বাকি অর্ধেক সময় থাকেন তার গ্রামের বাড়িতে।

জানি না সালাম নিজেকে নিয়ে কি ভাবে, কিন্তু আমি দেখি একজন সত্যকারের প্রতিভা, যিনি হয়ত দেশকে সত্যি কিছু দিতে পারত, কিন্তু কোথা থেকে তার জীবনটা কোথায় চলে গেল। হয়ত শিক্ষক হয়ে তার অসাধারন ক্ষমতাগুলো ছড়িয়ে দিতে পারতো আরো শত থেকে হাজার খানেক প্রতিভাবানদের মাঝে। জানতে ইচ্ছা করে, বিবেকের কাছে সালামের অনুভূতিটা কি রকম? দৈনিক জীবনের কোন কিছুই কি তাকে স্পর্শ করে না? অন্তত দায়িত্ববোধের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গিটা কি? একজন স্বামী হিসাবে, একজন বাবা হিসাবে, একজন ছেলে হিসাবে, একজন ভাই হিসাবে, একজন প্রকৌশলী হিসাবে অথবা সব বাদ দিয়ে এই দেশের একজন মানুষ হিসাবে? অবশ্য এ প্রশ্ন গুলো শুধু সালাম কে না, সবারই করা উচিত নিজেকে।